রাসায়নিক বন্ধন

রাসায়নিক বন্ধন(Chemical Bonding)

Science New Shyllabus-2024 Hand Note/ Goudie

নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান-2024

2024 সালের নতুন হ্যান্ড নোট বিজ্ঞান

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক জাতীয় শিক্ষাক্রম- ২০২২ অনুযায়ী প্রণীত এবং ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক বিজ্ঞান

অধ্যায় :7

রাসায়নিক বন্ধন

অধ্যায় 7:রাসায়নিক বন্ধন





এই অধ্যায়ে নিচের বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে:

  • যোজ্যতা, যৌগমূলক ও যোজনী
  • যৌগের রাসায়নিক সংকেত লেখার পদ্ধতি
  • নিস্ক্রিয় গ্যাস ও তাদের স্থিতিশীলতা
  • রাসায়নিক বন্ধন ও বন্ধন গঠনের কারণ
  • আয়নিক, সমযোজী ও ধাতব বন্ধন,
  • ধাতু নিষ্কাশন ও আকরিক, বিভিন্ন সংকর ধাতু

 তথ্য কণিকা(Information) 

  • মৌলিক গ্যাসের অণুসমূহ সাধারণত দ্বিপরমাণুক যেমন- O2, N2, F2, Cl2, Br2 ইত্যাদি।
  • কোনো কোনো মৌলের অণু দুইয়ের অধিক পরমাণু নিয়ে গঠিত হয়। যেমন- O3, P4, S8 
  • সব অণুতেই পরমাণুসমূহ এক বিশেষ আকর্ষণশক্তি দ্বারা পরস্পর আবদ্ধ থাকে, এ শক্তিকে বন্ধনশক্তি বলে।
  •  ধাতু-অধাতু মিলে সাধারণত আয়নিক বন্ধন, অধাতু-অধাতু মিলে সমযোজী বন্ধন গঠন করে।

যোজ্যতা ইলেকট্রন: 

কোনো মৌলের সর্বশেষ প্রধান শক্তিস্তরের মোট ইলেকট্রন সংখ্যাকে সেই মৌলের যোজন ইলেকট্রন বা যোজ্যতা ইলেকট্রন বলে।

 নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং এর স্থিতিশীলতা: '১৮' গ্রুপের মৌলসমূহকে নিষ্ক্রিয় গ্যাস বলা হয়।

নিম্নে নিষ্ক্রিয় গ্যাসসমূহের ইলেকট্রন বিন্যাস দেওয়া হলো :

  • He (2) : 1s2
  • Ne (10) : 1s2 2s2 2p6
  • Ar (18) : 1s2 2s2 2p6 3s2 3p6
  • Kr (36): 1s2 2s2 2p6 3s2 3p6 3d10 4s2 4p6
  • Xe (54) : 1s2 2s2 2p6 3s2 3p6 3d10 4s2 4p2 4p6 4d10 4f14 5s2 5p6
  • Rn (86) : 1s2 2s2 2p6 3s2 3p6 3d10 4s2 4p6 4d10 4f14 5s2 5p6 5d10 6s2 6p6

অষ্টক ও দুই-এর নিয়ম:

 বিভিন্ন মৌলের পরমাণুসমূহ নিজেদের মধ্যে ইলেকট্রন আদান-প্রদান এবং শেয়ারের মাধ্যমে পরমাণুসমূহের শেষ শক্তিস্তরে ২ টি অথবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আটটি ইলেকট্রনের বিন্যাস লাভ করে। এভাবে He -এর বিন্যাস লাভ করাকে দুই-এর (duplet or duet)  নিয়ম এবং যোজ্যতা স্তরে ৮ টি ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করাকে অষ্টক (octet)  নিয়ম বলে।

রাসায়নিক বন্ধন গঠনের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের মনে রাখতে হবে--

  • ১. কোনো মৌলের শেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন অর্থাৎ যোজ্যতা ইলেকট্রন বন্ধন গঠনে অংশগ্রহণ করে।
  • ২. প্রতিটি পরমাণুরই লক্ষ্য থাকে তার নিকটবর্তী নিষ্ক্রিয় মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করা।
  • ৩. 1 থেকে 17 পারমাণবিক সংখ্যাবিশিষ্ট মৌলসমূহ বন্ধন গঠন করলে খুব সহজেই দুই-এর(duplet)বা অষ্টক  (octet)নিয়ম মেনে চলে। তৃতীয় স্তরের সর্বোচ্চ ইলেকট্রন ধারণক্ষমতা ১৮ হওয়া সত্বেও কিছু মৌল উপরের তথ্যের ভিত্তিতে পরমাণুসমূহ বন্ধন গঠন করে এবংসে কারণেই একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ বা আসক্তির সৃষ্টি হয়। 

সুতরাং বলা যায় যে- যে আকর্ষণ বলের মাধ্যমে একটি পরমাণু অন্য পরমাণুর সাথে যুক্ত হয় তাকে রাসায়নিক বন্ধন বলে।

৫.৮ ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন: 

পাশাপাশি সোডিয়াম ও নিয়নের ইলেকট্রন বিন্যাসের চিত্র আঁক। 
কীভাবে সোডিয়াম, নিয়নের ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করবে?
Na-এর পারমাণবিক সংখ্যা11। তার শেষ শক্তিস্তরের একটি ইলেকট্রন ত্যাগের মাধ্যমে
Na+ আয়নের আধান গঠন


Na - e-          Na+
 2, 8, 1          2, 8
11 টি প্রোটনের আধান       = +11
10 টি ইলেকট্রনের আধান  = -10
                      মোট আধান  = +1
যে সকল মৌলের শেষ শক্তিস্তর বা যোজ্যতা স্তরে কম সংখ্যক (1,2,3) ইলেকট্রন থাকে সে সকল মৌলের ইলেকট্রন
পর্যায় সরণির একই পর্যায়ের অন্যান্য মৌলের তুলনায় নিউক্লিয়াস থেকে দূরে অবস্থান করে। 
ইলেকট্রনসমূহ নিউক্লিয়াসের সাথে দুর্বলভাবে আকর্ষিত থাকে। 
এই মৌলসমূহ ইলেকট্রন অপসারণ করে দুই এর বা অষ্টক পূর্ণ অবস্থায় পরিণত হতে চায়। 
যার ফলে এরা সহজেই ইলেকট্রন ত্যাগ করে। স্বাভাবিক অবস্থায় পরমাণুর ইলেকট্রন ও প্রোটন সংখ্যা সমান থাকে। একটি ইলেকট্রন ত্যাগের কারণে বিভিন্ন কক্ষপথে ইলেকট্রনের তুলনায় নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক আধানের পরিমাণ এক একক বেড়ে যায়।তখন এটি একক ধনাত্মক আধানযুক্ত পরমাণুতে পরিণত হয়। ধনাত্মক আধানযুক্ত পরমাণুকে ক্যাটায়ন বলে । 
দেখা যাচ্ছে ক্লোরিনের যোজ্যতা স্তরে ইলেকট্রন সংখ্যা 7, মোট ইলেকট্রন সংখ্যা17, অপর দিকে নিষ্ক্রিয় গ্যাস আর্গনের ইলেকট্রন সংখ্যা 18, যোজ্যতা স্তরে ইলেকট্রন সংখ্যা 8। আর্গনের ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করতে হলে ক্লোরিনের আরও একটি ইলেকট্রন প্রয়োজন।
Cl- আয়নের আধান গঠন- 


Cl + e-      Cl- 
2, 8, 7     2, 8, 8 
17টি প্রোটনের আধান = +17 
18 টি ইলেকট্রনের আধান = -18
                 মোট আধান = -1  
একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে ক্লোরিন পরমাণু একক ঋণাত্মক আধানযুক্ত ক্লোরাইড আয়নে পরিণত হয়।ঋণাত্মক আধানযুক্ত পরমাণুকে অ্যানায়ন বলে।
ইলেকট্রন আদান-প্রদানের মাধ্যমে গঠিত ক্যাটায়ন (ধনাত্মক আয়ন) এবং অ্যানায়নসমূহ (ঋণাত্মক আয়ন) যে আকর্ষণ বল দ্বারা যৌগের অণুতে আবদ্ধ থাকে তাকে আয়নিক বন্ধন বলে।
চেনার উপায়: ধাতু+ অধাতু= আয়নিক বন্ধন 
যেমন: MgO, NaCl,  
সমযোজী বন্ধন: সর্বশেষ শক্তিস্তরে স্থায়ী ইলেকট্রন বিন্যাস লাভের জন্য ইলেকট্রন শেয়ারের মাধ্যমে যে বন্ধন গঠিত হয়, তাকে সমযোজী বন্ধন বলে।
চেনার উপায়: অধাতু+ অধাতু= সমযোজী বন্ধন 
যেমন: H2O, NH3, CO2  এবং CH4

সমযোজী বন্ধনে গঠিত মৌলিক অণুকে (যেমন O2) সমযোজী অণু এবং যৌগকে সমযোজী যৌগ (যেমন CO2 ) বলে।কিছু সমযোজী অণু কম তাপমাত্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে (CO2, CH4, NH3 ইত্যাদি) কিছু তরল অবস্থায় থাকে  (H2O, C2H5OH  ইথানল ইত্যাদি) এবং কিছু কঠিন অবস্থায় থাকে {সালফার (S8), আয়োডিন (I2)  ইত্যাদি}।এদের অণুসমূহ দুর্বল ভ্যানডার ওয়ালস(van der Waals) শক্তি দ্বারা আবদ্ধ থাকে যা কম তাপমাত্রায় ভেঙে যায়। CO2, CH4, NH3  ইত্যাদির অণুসমূহের মধ্যে ভ্যানডার ওয়ালস(van der Waals) শক্তি নেই বললেই চলে, যার ফলে এরা গ্যাসীয় অবস্থায় একক অণু হিসেবে ঘুরে বেড়ায়। 
চিনির আণবিক সংকেত: C12H22O11.

ধাতব বন্ধন: 

ধাতব পরমাণুসমূহ যে আকর্ষণবল দ্বারা পরস্পরের সাথে আবদ্ধ থাকে তাকে ধাতব বন্ধন বলে । 



আমরা জানি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত 118 টি মৌলের ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুগুলো যুক্ত হয়েই বিভিন্ন অণু গঠন করে। সুতরাং, আমরা যত রকম পদার্থের কথাই বলি না কেন সকল পদার্থই অণু এবং পরমাণু দিয়ে গঠিত। অণুতে বিদ্যমান পরমাণুসমূহ সুবিন্যস্ত ভাবে সাজানো থাকে। অণুতে পরমাণুসমূহ যুক্ত থাকার কারণ হচ্ছে আকর্ষণ বল বা শক্তি; যাকে আমরা রাসায়নিক বন্ধন বলি। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বন্ধন রয়েছে যেগুলো নিয়ে আমরা এ অধ্যায়ে আলোচনা করব।

৪.১ যোজনী বা যোজ্যতা, যৌগমূলক

তোমরা আগের শ্রেণীতে যোজনী ও যৌগমূলক কী, এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছো। এখানে, যোজ্যতা, যৌগমূলক ও যোজনী সম্পর্কে আরেকটু বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। কোন মৌলের পরমানুর যোজ্যতা সম্পর্কে জানার আগে ঐ পরমাণুর যোজ্যতা ইলেকট্রন বলতে কী বপঝায় সেটি জানতে হবে।

যোজ্যতা ইলেকট্রন (Valence electron):

কোন মৌলের পরমাণুর সর্বোচ্চ শক্তিস্তর বা সর্বশেষ কক্ষপথে যে ইলেকট্রনগুলো থাকে সেই ইলেকট্রন সংখ্যাকে যোজ্যতা ইলেকট্রন বলে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায় যে, বোরন (B) ও অক্সিজেনের (O) ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে দেখা যায়, এদের সর্বশেষ কক্ষপথে যথাক্রমে3টি ও 6টি ইলেকট্রন রয়েছে। সুতরাং বোরন (B) ও অক্সিজেন (O) এর যোজ্যতা ইলেকট্রন সংখ্যা যথাক্রমে 3 ও 6। ছবিতে বোরন (B) এবং অক্সিজেনের (O) যোজ্যতা ইলেকট্রন দেখানো হলো।বোরন (B) ও অক্সিজেন (O) এর ইলেকট্রন বিন্যাস নিচে দেখানো হলোঃতোমরা নাইট্রোজেন (N), ফসফরাস (P), ও ক্লোরিনের (CI) ইত্যাদি মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে তাদের যোজ্যতা ইলেকট্রন কতো বের করার চেষ্টা করতে পারো।

যোজনী বা যোজ্যতা (Valency)

তোমরা ইতিমধ্যে জান যে, মৌলের পরমাণুসমূহ সর্বশেষ কক্ষপথের ইলেকট্রন গ্রহণ, ত্যাগ বা ভাগাভাগি করতে পারে। এভাবে পরমানুসমুহ ইলেকট্রন গ্রহণ বা ত্যাগ বা ভাগাভাগি করার মাধ্যমে অণু গঠন করে। আর অণু গঠনের সময় কোনো মৌলের একটি পরমাণুর সাথে আরেকটি পরমাণুর যুক্ত হওয়ার ক্ষমতাই হচ্ছে যোজনী বা যোজ্যতা (valency)। যোজনী বা যোজ্যতাকে এভাবেও বলা যায়:

কোনো মৌলের একটি পরমাণুর সাথে যত সংখ্যক হাইড্রোজেন (H) পরমাণু বা ক্লোরিন (Cl) পরমাণু যুক্ত হতে পারে, সেই সংখ্যাটিই হচ্ছে ঐ মৌলের যোজনী বা যোজ্যতা। আবার কোনো মৌলের একটি পরমাণুর সাথে যত সংখ্যক অক্সিজেন পরমাণু যুক্ত হতে পারে, সেই সংখ্যাটির দ্বিগুণ হচ্ছে ঐ মৌলের যোজনী বা যোজ্যতা। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায়,

অ্যামোনিয়া (NH3): নাইট্রোজেনের (N) 1টি পরমাণুর সাথে হাইড্রোজেনের (H) 3টি পরমাণু যুক্ত হয়েছে সুতরাং, নাইট্রোজেনের যোজনী 3।

সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl): সোডিয়ামের (Na) 1টি পরমাণুর সাথে ক্লোরিনের (Cl) 1টি পরমাণু যুক্ত হয়েছে। সুতরাং, সোডিয়ামের যোজনী 1।

ক্যালসিয়াম অক্সাইড (CaO): ক্যালসিয়ামের (Ca) 1টি পরমাণুর সাথে অক্সিজেনের 1টি পরমাণু যুক্ত হয়েছে। সুতরাং, ক্যালসিয়ামের যোজনী 2

আবার, কিছু মৌলের একাধিক যোজনী থাকে। যেমন, আয়রন (Fe) এর দুটি যোজনী আছে।

FeCl2: আয়রনের (Fe) 1টি পরমাণুর সাথে ২টি ক্লোরিন (Cl) পরমাণু যুক্ত হয়েছে। আয়রনের যোজনী 2

FeCl3: আয়রনের (Fe) 1টি পরমাণুর সাথে 3 টি ক্লোরিন (Cl) পরমাণু যুক্ত হয়েছে। আয়রনের যোজনী 3

কোনো মৌলের একাধিক যোজনী থাকলে ঐ মৌলের যোজনীকে পরিবর্তনশীল যোজনী বলা হয়। সুতরাং, আয়রন এর পরিবর্তনশীল যোজনী 2 ও 3।

যৌগমূলক (Radicals)

কোনো মৌলের একাধিক পরমাণুর একটি গ্রুপ বা পরমাণুগুচ্ছ যখন ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জসহ একটি মৌলের আয়নের মত আচরণ করে, তখন ঐ পরমাণুগুচ্ছকে যৌগমূলক বলা হয়। যৌগমূলকের একটি চার্জ থাকে, সেটি ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক দুইই হতে পারে। এই চার্জের সংখ্যাটিই হচ্ছে তাদের যোজনী। চার্জ ধনাত্মক বা ঋণাত্মক হতে পারে, কিন্তু যোজনী সবসময়েই একটি সংখ্যা ।



উদাহরণ: একটি ফসফরাস (P) পরমাণু, 3টি হাইড্রোজেন (H) পরমাণু, ও 1টি H' যুক্ত হয়ে ফসফোর্নিয়াম আয়ন (PH.') নামক যৌগমূলক তৈরি করে। যেহেতু, এই PH,' যৌগমূলকের চার্জের সংখ্যা +1, সুতরাং এর যোজনী হবে 1। সাধারণত, ধনাত্মক চার্জের যৌগমূলককে ক্ষারীয় যৌগমূলক (যেমন: NH) আর ঋণাত্মক চার্জের যৌগমূলককে অম্লীয় যৌগমূলক বলা হয় (যেমন: NO3)।

৪.২ যৌগের রাসায়নিক সংকেত (Chemical formula of a compound)

তোমরা পর্যায় সারণীতে দেখেছ, প্রত্যেকটা মৌলের পরমাণুর জন্য একটি এক কিংবা দুই ইংরেজি অক্ষরের সুনির্দিষ্ট প্রতীক রয়েছে। কোনো যৌগের রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে যে সকল মৌল দিয়ে ঐ যৌগটির রাসায়নিক গঠন হয়েছে তার একটি প্রতীকী উপস্থাপনা। অর্থাৎ, এখানে কোনো যৌগের অণুতে যে সকল পরমাণু থাকে, সে সকল পরমাণুর প্রতীক এবং সংখ্যার মাধ্যমে অনুটিকে প্রকাশ করা যায়। যেমন H2O হচ্ছে পানির একটি অনু, এখানে দুইটি হাইড্রোজেন (H) ও একটি অক্সিজেন (O) আছে, সুতরাং পানির রাসায়নিক সংকেত হলো H2O ।

নিচে রাসায়নিক সংকেত লেখার নিয়মগুলো উল্লেখ করা হলো:

১) কোনো মৌলের অণুর রাসায়নিক সংকেত লিখতে হলে ঐ অণুতে বিদ্যমান পরমাণুর প্রতীকটি লিখে মৌলটির প্রতীকের ডানপাশের নিচে ছোট করে (subscript) অণুতে মৌলের সংখ্যা লিখতে হবে। যেমন নাইট্রোজেন অণুতে 2টি নাইট্রোজেন পরমাণু (N) থাকে। সুতরাং, নাইট্রোজেন এর সংকেত N2।

কিছু মৌল আছে যারা অনু গঠন করে না, তাদেরকে শুধু প্রতীক দিয়ে বোঝানো হয়। যেমন সকল ধাতুসমূহ অণু গঠন করে না, কাজেই আয়রনকে বোঝাতে বা লিখতে হলে শুধু Fe লিখা হয়। আবার, নিষ্ক্রিয় গ্যাস গুলোও অনু গঠন করে না বলে এদেরকে লিখতেও শুধু তাদের প্রতীক ব্যবহার করা হয়। যেমন, হিলিয়াম লেখা হয় He হিসেবে।

২) কোনো যৌগের অনু যদি দুটি ভিন্ন মৌলের পরমাণু দিয়ে গঠিত হয় তাহলে যৌগটির অণুতে বিদ্যমান মৌল (কিংবা যৌগমূলক) দুটির প্রতীক পাশাপাশি লিখে একটি মৌলের পাশে নিচের দিকে ছোট করে অপর মৌলটির যোজনী লিখতে হবে। যেমন আমরা জানি, অ্যালুমিনিয়াম (Al) 

এর যোজনী 3 এবং অক্সিজেন (O) এর যোজনী 2 এই দুটি মৌল দিয়ে গঠিত যৌগ হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড, এর সংকেত Al2O3। এখানে,Al এর পাশে নিচের দিকে ছোট করে o এর যোজনী (2) লেখা হয়েছে এবং O এর পাশে নিচের দিকে ছোট করে AI এর যোজনী (3) লিখা হয়েছে। একইভাবে ক্যালসিয়াম (Ca) এর যোজনী 2 এবং ক্লোরিন (Cl) এর যোজনী 1, সুতরাং, উপরোক্ত নিয়ম অনুযায়ী ক্যালসিয়াম (Ca) ও ক্লোরিন (Cl) দিয়ে গঠিত ক্যালসিয়াম কোরাইড এর সংকেত হলো Cacl.।

তবে যৌগে উপস্থিত মৌলসমূহ বা যৌগমূলকের যোজনী একই হলে সংকেতে যোজনী লেখার প্রয়োজন হয় না। যেমন: ক্যালসিয়াম (Ca) এর যোজনী 2 এবং অক্সিজেন (O) এর যোজনী 2 এই দুটি মৌল দিয়ে গঠিত যৌগ ক্যালসিয়াম অক্সাইডকে Ca2O2 না লিখে CaO লেখা হয়।

আবার, কোনো মৌলের সাথে কোনো যৌগমূলক থাকলে এবং তাদের যোজনী জানা থাকলে উপরের নিয়ম অনুযায়ী তাদের দিয়ে গঠিত যৌগের সংকেত লেখা যাবে। যেমন, ম্যাগনেসিয়াম (Mg) একটি মৌল এবং এর যোজনী 2 এবং ফসফেট (PO,') একটি যৌগমূলক যার যোজনী 3। 

সুতরাং, নিয়ম অনুযায়ী এদের দিয়ে গঠিত ম্যাগনেসিয়াম ফসফেট এর সংকেত হবে Mg3(PO4)2। এক্ষেত্রে, কোন বিভ্রান্তির সুযোগ না রাখার জন্য যৌগমূলকটি প্রথম বন্ধনীর মধ্যে রেখে লিখতে হয়।


৩) যদি মৌল দুটির যোজনী কোন সাধারণ সংখ্যা দিয়ে বিভাজ্য হয়, তাহলে মৌল দুটির যোজনীকে সাধারণ সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মৌল দুটির পাশে প্রাপ্ত ভাগফলদ্বয় নিয়ম অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড অণু কার্বন (C) ও অক্সিজেন (O) এই দুটি মৌল দিয়ে গঠিত। 

এখানে, কার্বনের যোজনী 4 এবং অক্সিজেনের যোজনী 2, কিন্তু এটিকে আমরা C2O4 লিখি না। যেহেতু কার্বন ও অক্সিজেনের যোজনীকে দুই দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় যথাক্রমে 2 এবং 1। সুতরাং নিয়ম এক অনুযায়ী কার্বন (C) এর ডানপাশে নিচে 1 এবং অক্সিজেন (O) এর ডানপাশে নিচে 2 লিখার কথা, যেহেতু সংকেত লেখার সময় 1 সংখ্যাটি লেখা প্রয়োজন হয় না, তাই কার্বন-ডাই- অক্সাইড এর সংকেত হচ্ছে CO2 ।

৪.৩ নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং স্থিতিশীলতা (Inert gas and stability)

তোমরা ইতিমধ্যে জানো যে, নিষ্ক্রিয় গ্যাস সমূহ পর্যায় সারণির 18 নম্বর গ্রুপে অবস্থিত। নিষ্ক্রিয় গ্যাসসগুলোর এই নিষ্ক্রিয়তা বা স্থিতিশীলতার কারণ হচ্ছে এদের সর্বশেষ শক্তিস্তর ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ থাকে। হিলিয়ামের পারমানবিক সংখ্যা 2 কাজেই তার একটি মাত্র শক্তিস্তর সেটি হচ্ছে 1s, সেটি পূর্ণ করতে মাত্র 2টি ইলেকট্রনের প্রয়োজন এবং হিলিয়ামের সর্বশেষ কক্ষপথ বা শক্তিস্তরে রয়েছে সেই দুটি ইলেকট্রন। অন্যান্য নিষ্ক্রিয় গ্যাসসমূহের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন দিয়ে s এবং p অরবিটাল পূর্ণ থাকে। নিচে কয়েকটি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস দেখানো 

হলোঃ

কাজেই নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, হিলিয়ামের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ২টি এবং অন্যান্য নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ক্ষেত্রে ৪ (আট) টি ইলেকট্রন থাকায় তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তর পূর্ণ করতে আর ইলেকট্রনের প্রয়োজন নেই। তাই এরা স্থিতিশীলতা অর্জন করে। কোনো মৌলের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪ (আট) টি ইলেকট্রন থাকলে এরা সর্বাধিক স্থিতিশীল হয়। নিষ্ক্রিয় গ্যাসসমূহ অধিক স্থিতিশীল হওয়ার দরুন তারা অন্য মৌলকে ইলেকট্রন প্রদান করে না আবার গ্রহণও করে না। ফলে, এরা রাসায়নিকভাবে আসক্তিহীন বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

অষ্টক এর নিয়ম (Octet Rule): 

আমরা জানি যে, যেহেতু নিষ্কৃয় গ্যাসগুলো সবচেয়ে বেশি স্থিতিশীল তাই প্রতিটি মৌলই তার সর্বশেষ শক্তিস্তরে (valence shell) নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করতে চায় অর্থাৎ তাদের সর্বশেষ শক্তি স্তরে ৮টি ইলেকট্রন অর্জন করার প্রবণতা দেখায়। একমাত্র হিলিয়াম (He) ছাড়া বাকি সব নিষ্ক্রিয় গ্যাসেরই সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৮টি ইলেকট্রন আছে। তাই মৌল বা পরমাণু সমূহ যখন অনু গঠন করে তখন তারা ইলেকট্রন গ্রহণ, ত্যাগ বা ভাগাভাগি (sharing) করার মাধ্যমে তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪ (আট) টি ইলেকট্রন ধারণ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মত ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে। একেই “অষ্টক” নিয়ম (Otctate rule) বলা হয়।

উদাহরণ: মিথেন (CH.) অনুতে কার্বন (C) পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪ (আট) টি ইলেকট্রন আছে। এই ৪ (আট) টি ইলেকট্রনের মধ্যে এটি কার্বনের আর এটি ইলেকট্রন হাইড্রোজেন (H) পরমাণু থেকে আসে। 

নিচের চিত্রে সেটি দেখানো হলো:


৪.৬ রাসায়নিক বন্ধন (Chemical Bond)

কোনো রাসায়নিক যৌগ গঠন করতে দুই বা ততোধিক পরমাণু, অণু বা আয়নের মধ্যে বন্ধনই হচ্ছে রাসায়নিক বন্ধন। এই রাসায়নিক বন্ধন যৌগের পরমাণুগুলোকে একত্রিত করে রাখে বা ধরে রাখে। যেমন, দুটি হাইড্রোজেন (H) পরমাণু পরস্পরের সাথে বন্ধনে যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন অণু (H.) 



গঠন করে। অর্থাৎ, এখানে বন্ধন গঠনের জন্য দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ বল কাজ করেছে এবং এই আকর্ষণ বলই হচ্ছে মূলত রাসায়নিক বন্ধন। অতএব, অণু গঠনের জন্য পরমাণুসমূহ যে আকর্ষণের মাধ্যমে যুক্ত থাকে, তাকে রাসায়নিক বন্ধন বলে।বন্ধন গঠনের কারণ হচ্ছে, আসলে প্রত্যেক মৌলই তার সর্বশেষ শক্তিস্তরে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মত ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে স্থিতিশীল হতে চায়। 

তাই যখন একই মৌল বা ভিন্ন মৌলের দুটি পরমাণু কাছাকাছি আসে তারা তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন গ্রহণ বা ত্যাগ বা ভাগাভাগি করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মত স্থিতিশীল ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে। ফলে, পরমাণু গুলোর মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি হয়। আর এই আকর্ষণের কারণেই রাসায়নিক বন্ধন গঠিত হয়।

৪.৬.১ আয়নিক বন্ধন (Ionic Band)

পর্যায় সারণি পড়ার সময় তোমরা দেখেছ ধাতুগুলোর আয়নিকরণ শক্তির মান অনেক কম। ফলে, এরা অতি সহজেই তাদের সর্বশেষ শক্তি স্তরের 

ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট আয়ন বা ক্যাটায়নে পরিণত হতে পারে। আবার, অধাতুসমূহের ইলেকট্রন আসক্তির মান বেশি হওয়ায় তারা তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক বা নেগেটিভ চার্জ বিশিষ্ট আয়ন বা অ্যানায়নে পরিণত হতে পারে। এভাবে সৃষ্ট হওয়া ক্যাটায়ন এবং অ্যানায়ন পরস্পরের মধ্যে এক ধরনের তড়িত আকর্ষণ বল কাজ করে তাদের নিজেদের ধরে রেখে বন্ধন তৈরি করতে পারে। এই বন্ধনই হচ্ছে আয়নিক বন্ধন।

উদাহরণ: এখানে, উদাহরণ দেওয়ার জন্য সোডিয়াম আয়ন (Na) এবং ক্লোরাইড আয়ন (CI) এর মধ্যে সৃষ্ট বন্ধনের ফলে তৈরি সোডিয়াম ক্লোরাইডের (NaCl) কথা বলা যেতে পারে। এই Nacl এ আয়নিক বন্ধন বিদ্যমান।

সোডিয়াম (Na) এর সর্বশেষ শক্তিস্তরের একটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মত ইলেকট্রন বিন্যাস (সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪(আট) টি ইলেকট্রন) অর্জন করে সোডিয়াম আয়ন (Na') পরিণত হয় যা আমরা ইতিমধ্যে জানি। আবার ক্লোরিন (Cl) ও তার সর্বশেষ শক্তিস্তরে একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মত ইলেকট্রন বিন্যাস (সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪ (আট)টি ইলেকট্রন) অর্জন করে ক্লোরাইড আয়ন (CI)এ পরিণত হয়।

সুতরাং, এভাবে তৈরিকৃত সোডিয়াম আয়ন (Na') এবং ক্লোরাইড আয়ন (CI) পরস্পরের সাথে ইলেকট্রোস্ট্যাটিক আকর্ষণ বলএর মাধ্যমে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আর, এভাবে ইলেক্ট্রস্ট্যাটিক আকর্ষণ বলের মাধ্যমে সৃষ্ট বন্ধনই হচ্ছে আয়নিক বন্ধন। আর, যে যৌগে এ বন্ধন 

বিদ্যমান থাকে তাকে আয়নিক যৌগ বলে। নিচের চিত্রে সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) এর আয়নিক বন্ধন তৈরি দেখানো হলো।এখানে উল্লেখ্য, পর্যায় সারণির 1 ও 2 নম্বর গ্রুপের ধাতব মৌলগুলো এবং গ্রুপ-16 ও গ্রুপ-17 এর অধাতু মৌলগুলো সাধারণত আয়নিক বন্ধন তৈরি করে।

৪.৬.২ সমযোজী বন্ধন (Covalent bond)

আমরা জানি যে, অধিক আয়নিকরণ শক্তি সম্পন্ন মৌলগুলো ইলেকট্রন ত্যাগ করতে পারে না, আবার কম ইলেকট্রন আসক্তি সম্পন্ন মৌলসমূহ সহজে ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারে না। যেমন ক্লোরিন (Cl) এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে 7টি ইলেকট্রন আছে। ফলে, ক্লোরিন তার শক্তিস্তর থেকে 7টি ইলেকট্রন ত্যাগ করতে চাইবে না বরং একটি বা দুইটি গ্রহণের প্রবণতা দেখাবে। এক্ষেত্রে, দুটি ক্লোরিন পরমাণু যখন নিজেদের কাছাকাছি আসবে, তখন প্রত্যেকটি ক্লোরিন পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তর থেকে একটি করে ইলেকট্রন এসে জোড়বদ্ধ হয়ে উভয় পরমাণুই ইলেকট্রন দুটি ভাগাভাগি করে নেবে। একে ইলেকট্রন শেয়ারিং (Sharing of electron) বলে।

ফলস্বরূপ, দুটি ক্লোরিন পরমাণুই তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪(আট) টি করে ইলেকট্রন লাভ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করবে। 

যে কারণে দুটি ক্লোরিনের পরমাণুই একে অপর থেকে দূরে সরে যেতে পারে না এবং এরা এক ধরনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ ধরনের বন্ধনকে সমযোজী বন্ধন (Covalent bond) বলে। সমযোজী বন্ধন দিয়ে যে যৌগ তৈরি হয় তাকে সমযোজী যৌগ বলে।

৪.৬.৩ ধাতব বন্ধন(Metallic bond) 

আমরা আয়নিক বন্ধনে একটি ধাতু ও অপর একটি অধাতুর মধ্যে বন্ধন দেখেছি। আবার, সমযোজী বন্ধনে দুটি অধাতব পরমাণুর মধ্যে ৰন্ধন দেখেছি। কিন্তু, যখন দুটি ধাতব পরমাণু একসাথে বা কাছাকাছি আসে তখন কি ঘটে? আসলে, দুটি ধাতব পরমাণু কাছাকাছি আসলে তাদের পরমাণুর মধ্যে যে বন্ধন গঠিত হয় তাকে ধাতব বন্ধন (Metallic bond) বলে। যেমন, তামা, লোহা বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি জিনিসপত্র, রূপা বা সোনার অলংকার, ইত্যাদিতে ধাতব বন্ধন বিদ্যমান।

পানি (HO) একটি সমযোজী যৌগ। এখানে, একটি অক্সিজেন (O) পরমাণু দুইটি হাইড্রোজেন (H) পরমাণুর সাথে সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু অক্সিজেন পরমাণু হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে বেশি তড়িৎ ঋণাত্মক হওয়ায় পানির অনুর সমযোজী বন্ধনে ব্যবহৃত ইলেকট্রন

 দুটি অক্সিজেনের দিকে সামান্য সরে যায়, সে কারণে অক্সিজেন পরমাণু আংশিক ঋণাত্মক চার্জ প্রাপ্ত হয়। অন্য দিকে হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে ইলেকট্রনগুলি শরে যাওয়ার কারণে সেগুলো আংশিক ধনাত্মক চার্জপ্রাপ্ত হয়। উল্লেখ্য, পানিতে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে দুটি সমযোজী বন্ধন থাকে এবং এই বন্ধনের জন্য দুটি ইলেকট্রনের প্রয়োজন হয়।

আমরা জানি যে, ধাতব পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাসে তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে সাধারণত 1টি,2টি ও 3টি ইলেকট্রন থাকে। এসব ধাতুর আকার একই পর্যায়ে অবস্থিত অধাতুর চেয়ে বড় হয়। ফলে, তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনের প্রতি নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ কম হয় এবং



এভাবে, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের সমযোজী যৌগকে পোলার সমযোজী যৌগ (Polar covalent compound) বলে। সুতরাং, পানি হচ্ছে পোলার সমযোজী যৌগ এবং পোলার স্নানক।

যেমন-পানিতে যখন আয়নিক যৌগ যোগ করা হয়, তখন পানির অনুর ধনাত্বক প্রান্ত আয়নিক যৌগের ঋণাত্মক প্রান্ত বা অ্যানায়ন কে আকর্ষণ কর। অনুরূপভাবে, পানির ঋণাত্মক প্রান্ত আয়নিক যৌগের ধনাত্মক প্রান্তকে আকর্ষণ করে। যখন এ আকর্ষণ বলের মান আয়নিক যৌগের ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নের মধ্যকার আকর্ষণ বল থেকে বেশি হয়, তখন ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পানির অনু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যায়। আর এভাবেই আয়নিক যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয়।

অন্যদিকে, সমযোজী যৌগে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্ত থাকে না। ফলে, এ সব যৌগ পানির ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে কোন আকর্ষণ বা বিকর্ষণ কাজ করে না। তাই, সমযোজী যৌগ পানিতে পানিতে দ্রবীভূত হতে পারে না।


এরা সহজে ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আয়নে পরিণত হতে পারে। এই ধনাত্মক আয়নকে পারমাণবিক শাঁস (Atomic core) বলা হয়।ধাতব পরমাণু থেকে ত্যাগ করা ইলেকট্রনগুলো পারমাণবিক শাঁসের মধ্যবর্তী স্থানে মুক্তভাবে ঘোরাফেরা বা চলাচল করতে পারে। এ ধরনের 

ইলেকট্রনকে সঞ্চারণশীল ইলেকট্রন (Delocalized electron) বলে। আসলে, এই ইলেকট্রনগুলো কোন নির্দিষ্ট পরমাণুর অধীনে না থেকে পুরো ধাতব খন্ডের সবগুলো ধাতব আয়নের হয়ে যায়। ফলে দেখা যায়, সব ধাতব আয়নই এই সঞ্চারণশীল ইলেকট্রনের প্রতি এক ধরনের স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণে আকর্ষিত হয়। 

এ কারণে, দুটি ধাতব আয়ন তাদের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না এবং এটিই হচ্ছে ধাতব বন্ধনের কারণ। আবার, ধাতুর মধ্যে এ সঞ্চরণশীল ইলেকট্রনিই ধাতুর বিদ্যুৎ পরিবাহিতা, তাপ পরিবাহিতা, নমনীয়তা, ইত্যাদি ধর্মের জন্য দায়ী।


৪.৭ আকরিক, ধাতু নিষ্কাশন ও সংকর ধাতু

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা ধরণের ধাতু ব্যবহার করি। এইসব ধাতুকে খনি থেকে আকরিক হিসেবে উত্তোলন করে লাভজনক উপায়ে সংগ্রহ বা নিষ্কাশন (extract) করে ব্যবহারোপযোগী। এ সম্পর্কে জানতে হলে তোমাদের আকরিক ও ধাতু নিষ্কাশন সম্পর্কে জানতে হবে। 



আকরিক

মাটির তলদেশ বা উপরিভাগে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান যে সকল পদার্থ থেকে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধাতু বা অধাতু সংগ্রহ করা হয়, তা খনিজ হিসেবে পরিচিত। আর যে সকল খনিজ থেকে লাভজনক উপায়ে ধাতু বা অধাতু সমূহকে সংগ্রহ বা নিষ্কাশন করা যায়, সে সকল খনিজকে আকরিক (ore) বলে।

উদাহরণ: গ্যালেনা (লেড সালফাইড, Pbs) হচ্ছে লেড (Pb) ধাতুর আকরিক। কারণ, গ্যালেনা থেকে লাভজনকভাবে লেড (Pb) ধাতু সংগ্রহ বা নিষ্কাশন করা যায়। হেমাটাইট থেকেও লাভজনক উপায়ে আয়রন বা লোহাকে নিষ্কাশন করা যায় তাই হেমাটাইট (Haematite, Fe2O3) হলো আয়রন বা লোহার (Fe) আকরিক। 

ধাতু নিষ্কাশন (Metal Extraction)

আমরা জানি যে, সকল ধাতুর সক্রিয়তা (reactivity) একরকম নয়। কিছু ধাতু কম সক্রিয়, কিছু মোটামুটি সক্রিয়, আবার কিছু ধাতু অধিক সক্রিয়। সে কারণে বিভিন্ন ধাতুর ধর্মও বিভিন্ন হয়ে থাকে। এইসব ধাতুসমূহের মধ্যে কিছু ধাতু মুক্ত অবস্থায় থাকে এবং কিছু ধাতু তাদের সংশ্লিষ্ট আকরিকের সাথে যুক্ত অবস্থায় থাকে। যে পদ্ধতিতে ধাতুকে তার সংশ্লিষ্ট আকরিক থেকে সংগ্রহ করা যায়, তাকে ধাতু নিষ্কাশন বলে।

এই ধাতুগুলোকে আকরিক থেকে পৃথক করতে নির্দিষ্ট কোনো একটি প্রক্রিয়া নেই। সেই কারণে ভিন্ন ভিন্ন ধাতুর নিষ্কাশন প্রক্রিয়াও ভিন্ন। যে সমস্ত ধাতু খুব কম সক্রিয়, যেমন সোনা (Au), প্লাটিনাম (Pt), রূপা (Ag) এদেরকে কখনো কখনো প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।

আবার অধিক সক্রিয় ধাতুগুলোকে তাদের অক্সাইড, সালফাইড, নাইট্রেট, কার্বনেট, ইত্যাদি যৌগ হিসেবে প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। এইসব সক্রিয় ধাতুগুলোকে আকরিক থেকে পৃথক করতে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়। যেমন, বিজারণ (reduction) পদ্ধতি, তড়িৎ বিশ্লেষণ (electrolysis) পদ্ধতি ইত্যাদি। ধাতুগুলোকে তাদের আকরিক থেকে পৃথক বা নিষ্কাশন করার জন্য আকরিককে চূর্ণ-বিচূর্ণ, ঘনীকরণ, বিশুদ্ধকরণ ইত্যাদি বেশ কিছু ধাপ সম্পন্ন করতে হয়। প্রত্যেক ধাতুর ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে সেই ধাতুরগুলোর জন্য উপযোগী ধাপসমূহ অনুসরণ করে তাদেরকে সংশ্লিষ্ট আকরিক থেকে পৃথক বা নিষ্কাশন করা হয়।

সংকর ধাতু

সংকর ধাতু হচ্ছে দুই বা ততোধিক ধাতুর সংমিশ্রণ থেকে তৈরি একটি পদার্থ। ধাতুগুলোর সংমিশ্রণ করার জন্য সাধারণত নির্ধারিত কতগুলো ধাতুকে একত্রে গলানো হয়। এই গলিত মিশ্রণকে ঠান্ডা করলে যে ধাতব মিশ্রণ পাওয়া যায়, তাকে সংকর ধাতু বলে।

প্রাচীন তাম্র যুগে মানুষ গয়না, বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি তৈরি করতে তামা (Cu) ব্যবহার করত। এই তামা বা কপার নরম ধাতু বলে ।



সেগুলো বেশিদিন কার্যকর থাকতো না। সেজন্য, সেই প্রাচীনকাল থেকেই কপার (Cu) এর সাথে টিন (Sn) কে গলিয়ে মিশ্ৰণ তৈরি করে, পরবর্তীতে সে মিশ্রণকে ঠান্ডা করে ব্রোঞ্জ তৈরি করা হয়। ব্রোঞ্জ হচ্ছে এক প্রকার সংকর ধাতু, এই ব্রোঞ্জ দিয়ে বিভিন্ন রকমের হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি তৈরি করে ব্যবহার করা হতো।

একইভাবে, লোহার (Fe) সাথে কার্বন (C) মিশিয়ে যে সংকর ধাতু তৈরি করা হয় যাকে আমরা স্টিল বলি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে ছুরি, কাঁচি ব্যবহার করে করি তা স্টিল দিয়ে তৈরি। এছাড়া, স্টিল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতিও তৈরি করা হয়। আবার লোহার সাথে কার্বন 

(C), নিকেল (Ni), ম্যাঙ্গানিজ (Mn) ও ক্রোমিয়াম (Cr) মিশিয়ে স্টেইনলেস স্টিল (Stainless steel) তৈরি করা হয় যা মরিচাবিহীন থাকে। রান্নার পাত্র ও রান্নার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অস্ত্রপচারের সরঞ্জাম তৈরিতে স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহার করা হয়।পাশের টেবিলে কয়েকটি পরিচিত সংকর ধাতুতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান ও পরিমাণ উল্লেখ করা হলো।


প্রয়োজনীয় লিংক সমূহঃ নতুন শিক্ষা কার্যক্রম নবম শ্রেণী বিজ্ঞান




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনেট আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url