জিনতত্ত্ব ও বংশগতিবিদ্যা

Science New Shyllabus-2024 Hand Note/ Goudie

নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান-2024

2024 সালের নতুন হ্যান্ড নোট বিজ্ঞান

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক জাতীয় শিক্ষাক্রম- ২০২২ অনুযায়ী প্রণীত এবং ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক বিজ্ঞান

অধ্যায় :6

জিনতত্ত্ব ও বংশগতিবিদ্যা


এই অভিজ্ঞতায় শিখতে পারবে-

  • জিনতত্ত্ব কী?
  • জিনতত্ত্ব ও ও বংশগতিবিদ্যার সম্পর্ক
  • মেন্ডেল, তার গবেষণা এবং বংশগতিবিদ্যার বৈজ্ঞানিক পাঠ
  • জীবে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ
  • বংশগতিবিদ্যার নীতি ব্যবহার করে জীবের বৈশিষ্ট্য নির্বাচন (সংকরায়ন, জেনেটিক সিলেকশন)

আমাদের জীবজগত অসংখ্য বৈচিত্র্য নিয়ে বিদ্যমান। আদিকাল থেকেই মানুষ তার জন্য উপকারী উদ্ভিদ ও প্রাণীদের নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে এসেছে। তোমরা ইতোমধ্যে হরিপদ কাপালীর আবিষ্কৃত হরিধানের নাম শুনেছ, তিনি তার ধান ক্ষেতে অজানা প্রজাতির ধান দেখতে পেয়ে ওখান থেকে বীজ তৈরি করেন যা পরবর্তিতে উচ্চফলনশীল জাত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তিনি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না জেনেই ধানের উচ্চফলনশীল বৈশিষ্ট্যটি তার পরবর্তি প্রজন্মে স্থানান্তর করেছিলেন। আবহমান কাল জুড়েই আমাদের দেশের কৃষকরা এরূপ করে আসছে।

প্রজনন জীবের একটি স্বাভাবিক ও অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ন একটি বৈশিষ্ট্য, প্রজননের মাধ্যমে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য পরবর্তী বংশধরে সঞ্চালিত হয় এবং জীব তার নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখে। এভাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরের প্রক্রিয়া বংশগতি (heredity) নামে পরিচিত। বংশগতির মৌলিক একক হলো জিন। তোমরা কোষের ক্রোমোজোমে যে ডি.এন.এ সম্পর্কে জেনেছ সেখানে জীবের জিনগুলো সজ্জিত থাকে। সাধারণত জিন দ্বারাই প্রজাতির বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়, এক কথায় নিয়ন্ত্রিত হয়। বিজ্ঞানের যে শাখায় জিনের গঠন, নিয়ন্ত্রণ, প্রকাশ, কার্যপদ্ধতি ও তার বংশানুক্রমিক সঞ্চালন পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয় তাকে জিনতত্ত্ব (Genetics) বলে। এই অধ্যায়ে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল ও তার গবেষণা

গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল

গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল ( Gregor Johann Mendel, 1822-1884 ) তার গবেষণায় প্রথম জীবের একটি বৈশিষ্ট বংশানুক্রমে স্থানান্তরের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছিলেন। জিনতত্ত্বের জনক হিসেবে স্বীকৃত এই বিজ্ঞানী ছিলেন বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রবাসী একজন ধর্মযাজক। দীর্ঘ সাত বছর তিনি মটর শুঁটি গাছের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালিয়ে বংশগতি সম্পর্কিত তার মতামত প্রকাশ করেন। কিন্তু মেন্ডেলের প্রকাশিত নিবন্ধটি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোকচক্ষুর অগোচরেই রয়ে যায়। মেন্ডেলের মৃত্যুর ১৬ বছর পর হিউগো দ্য ভ্রিস, কার্ল করেন্স এবং এরিক, স্কেরমেক নামে তিনজন বিজ্ঞানী পৃথকভাবে কিন্তু একই সময়ে মেন্ডেলের গবেষণার ফলাফল পুনরাবিষ্কার করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এ বিজ্ঞানীরা তাঁদের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করার পর মেন্ডেলের গবেষণা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। এভাবে মেন্ডেলের গবেষণার মাধ্যমে বংশগতির মৌলিক সূত্রের আবিষ্কার ও প্রকাশের মাধ্যমে যে ভিত্তি রচিত হয় তার উপর নির্ভর করে জীববিজ্ঞানে বংশগতিবিদ্যা বা জিনতত্ত্ব নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার বিকাশ ঘটে। এ কারণে মেন্ডেলকে বংশগতিবিদ্যার জনক (Father of Genetics) বলে অভিহিত করা হয়। 

মেন্ডেলের গবেষণা ও জীবের বৈশিষ্ট্য নির্বাচন

জোহান গ্রেগর মেন্ডেল ব্যক্তি জীবনে একজন ধর্ম যাজক হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন খাটি বিজ্ঞানী ছিলেন। বংশগতিবিদ্যা পরীক্ষার জন্য তিনি তার মঠের বাগানে নিয়ন্ত্রিত পরাগায়নের মাধ্যমে সঙ্করায়ণ (Hybridization) করার জন্য মটরশুঁটি উদ্ভিদকে নির্বাচন করেন এবং ১৮৫৭ সাল থেকে তাঁর গবেষণা শুরু করেন। মেন্ডেল তাঁর পরীক্ষার জন্য মটরশুঁটি গাছকে নমুনা হিসেবে মনোনীত করার বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন, 

(১) মটরশুঁটি গাছ একবর্ষজীবী হওয়ায় খুব কম সময়ের মধ্যেই সংকরায়ন পরীক্ষার ফল পাওয়া যায়।

 (২) এটি একটি উভলিঙ্গী উদ্ভিদ এবং স্বপরাগায়নের মাধ্যমে যৌন প্রজনন সম্পন্ন করে। 

(৩) ফুলগুলো আকারে বড় হওয়ায় মটরশুঁটি গাছে অতি সহজেই সংকরায়ন ঘটানো যায়। 

(৪) পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবককে ঘিরে দলমণ্ডল (Corolla) এমনভাবে সাজানো থাকে যে পরনিষেকের (Cross fertilization) কোন সম্ভাবনা থাকে না। 

বিজ্ঞান (SSC)


ফলে বিভিন্ন জাতের মটরশুঁটি উদ্ভিদের যেমন, 

  • (১) মটরশুঁটি গাছ একবর্ষজীবী হওয়ায় খুব কম সময়ের মধ্যেই সংকরায়ন পরীক্ষার ফল পাওয়া যায়। 
  • (২) এটি একটি উভলিঙ্গী উদ্ভিদ এবং স্বপরাগায়নের মাধ্যমে যৌন প্রজনন সম্পন্ন করে।
  • (৩) ফুলগুলো আকারে বড় হওয়ায় মটরশুঁটি গাছে অতি সহজেই সংকরায়ন ঘটানো যায়। 
  • (৪) পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবককে ঘিরে দলমণ্ডল (Corolla) এমনভাবে সাজানো থাকে যে পরনিষেকের (Cross fertilization) কোন সম্ভাবনা থাকে না। ফলে বিভিন্ন জাতের মটরশুঁটি উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যগুলো খাঁটি বা বিশুদ্ধ অবস্থায় থাকে। 
  • (৫) মটরশুঁটি গাছে একাধিক সুস্পষ্ট তুলনামূলক বিপরীত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তাই অপত্য বংশে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট  প্রকাশ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। 
  • (৬) সংকরায়ণে সৃষ্ট বংশধরগুলো উর্বর (fertile) প্রকৃতির হওয়ায় সেগুলো নিয়মিত বংশবৃদ্ধি করতে পারে।

মেন্ডেল বিভিন্ন উৎস থেকে ৩৪ ধরনের মটরশুঁটি উদ্ভিদের বীজ সংগ্রহ করে আশ্রমের বাগানে প্রায় এক বৎসর প্রত্যেক ধরনের বীজের নির্দিষ্ট বৈশিষ্টের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা শেষে তিনি কাণ্ডের দৈর্ঘ্য, ফুলের অবস্থান, ফুলের রং, ফলের বর্ণ, ফলের আকৃতি, বীজের বর্ণ এবং বীজের আকৃতি এই সাতটি বৈশিষ্টের (trait) প্রত্যেকটির জন্য দুটি করে বিপরীত লক্ষণ সম্পন্ন মোট ১৪টি খাঁটি উদ্ভিদ নির্বাচন করেন। 

অর্থাৎ কাণ্ডের দৈর্ঘ বৈশিষ্টের জন্য লম্বা ও খাটো এই দুটি বিপরীত লক্ষণ, ফুলের বর্ণ বৈশিষ্টের জন্য সাদা ও বেগুনী এই দুটি লক্ষণ, বীজের আকৃতির জন্য গোলাকার ও কুঞ্চিত এই দুটি লক্ষণ ইত্যাদি (ছবি দ্রষ্টব্য) । শুরুতে মেন্ডেল লম্বা এবং খাটো এই বিপরীত লক্ষণযুক্ত দুধরনের মটরশুঁটি গাছ নিয়ে তাঁর পরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এটি যেহেতু শুধুমাত্র কান্ডের দৈর্ঘ্য, এই একটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত উদ্ভিদ নিয়ে পরীক্ষা ছিল তাই এটিকে মনোহাইব্রিড ক্রস (monohybrid cross) বলা হয়ে থাকে (mono অর্থ একটি)।

পরীক্ষা শুরু করার আগে তিনি মটরশুঁটি গাছের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে নেন। এরপর শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত একটি লম্বা উদ্ভিদের সঙ্গে শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত একটি খাটো উদ্ভিদের কৃত্রিম পরাগসংযোগ ঘটান অর্থাৎ লম্বা উদ্ভিদের পরাগরেণু নিয়ে খাটো উদ্ভিদের গর্ভমুন্ডে স্থাপন করেন। লম্বা ও খাটো উদ্ভিদের মাঝে সংকরায়নের পরেও সবগুলো উৎপন্ন বীজ থেকে শুধুমাত্র লম্বা উদ্ভিদ পাওয়া যায়। প্রথম সংকরায়নের ফলে পাওয়া এই উদ্ভিদগুলোকে মেন্ডেল প্রথম বংশধর বা F1 বলে নামকরণ করেন। এবারে তিনি F1 বংশধরের উদ্ভিদগুলোর নিজেদের মধ্যে পরাগসংযোগ করে সংকরায়ন ঘটান। দ্বিতীয়বার সংকরায়নের ফলে সৃষ্ট দ্বিতীয় বংশধর F2 তে ৩:১ অনুপাতে লম্বা এবং খাটো উদ্ভিদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ F1 বংশধরের দৃশ্যমান লম্বা উদ্ভিদের মাঝে কোনোভাবে খাটো উদ্ভিদের বৈশিষ্ট লুক্কায়িত ছিল, যেটি দ্বিতীবার সংকারয়নের সময় বের হয়ে এসেছে।

পরবর্তীতে মেন্ডেল বীজের বর্ণ (লক্ষণ হলুদ কিংবা সবুজ) এবং বীজের আকার (লক্ষণ গোলাকার কিংবা কুঞ্চিত) এই দুটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত মটরশুঁটি গাছ নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন, দুটি ভিন্ন বৈশিষ্ট নিয়ে পরীক্ষার কারণে এটিকে ডাইহাইব্রিড ক্রস (dihybrid cross, di অর্থ দুই) বলা হয়। একটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত হলুদ বর্ণ এবং গোলাকার বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদের সাথে অপর একটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত সবুজ বর্ণ এবং কুঞ্চিত বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদের সংকরায়নে দেখা গেল F1 বংশধরের সবগুলো উদ্ভিদই হলুদ বর্ণের গোলাকার বীজ উৎপন্ন করে। F, বংশধরের উদ্ভিদগুলোর নিজেদের মধ্যে সংকরায়ন করে F2 বংশধরের মাঝে দেখা গেল, ১৬টি বংশধরের মধ্যে ৯টি হলুদ-গোল, ৩টি হলুদ- কুঞ্চিত, ৩টি সবুজ-গোল ও ১টি সবুজ-কুঞ্চিত বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদ (ছবি দ্রষ্টব্য)।

প্রথম দৃষ্টিত তোমাদের কাছে মেন্ডেলের পর্যবেক্ষণগুলোকে যথেষ্ট জটিল মনে হলেও ম্যান্ডেলের দুটি সূত্র ব্যবহার করে তুমি খুব সহজেই এই পর্যবেক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করতে পারবে। তার আগে তোমাকে জীবে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট সংক্রান্ত দুই একটি বিষয় জেনে নিতে হবে।

জীবে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ

মেন্ডেলের গবেষণার একটি গুরত্বপূর্ন দিক ছিলো জীবে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ। তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ যে জীবদেহে প্রাথমিক স্তরে জিনের মাধ্যমে বংশ হতে বংশান্তরে বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হয়। ফুলের রঙ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় মেন্ডেল লক্ষ্য করেন যে মটরশুটি ফুলের রঙ হয় সাদা নয়তো বেগুনি হয়, এদের মাঝামাঝি কিছু হয় না। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট জিন ফুলের রং বা বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট নির্ধারিত করে থাকে। প্রতিটি স্বতন্ত্র উদ্ভিদের প্রত্যেকটি জিনের দুটি করে প্রতিরূপ আছে যার একটি পিতা এবং অন্যটি মাতার কাছ থেকে এসেছে। জিনের এই প্রতিরূপ দুটিকে অ্যালিল (Allele) বলা হয়। কোন নির্দিষ্ট জীবের অ্যালিলগুচ্ছকে তার জিনোটাইপ বলে, আর তার পর্যবেক্ষণযোগ্য বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে তার ফিনোটাইপ বলে।

ডিপ্লয়েড জীবের দুটি অ্যালিল একই রকম বা ভিন্ন হতে পারে। যদি অ্যালিল দুটি একই রকম হয় তখন তাকে হোমোজাইগাস বলে, আর ভিন্ন হলে হেটারোজাইগাস বলা হয়। হেটারোজাইগাস জীবে যে অ্যালাইলটি ওই জীবের ফিনোটাইপে প্রাধান্য বিস্তার করে—অর্থাৎ যে বৈশিষ্টটি প্রকাশিত হয়, সেটি প্রকট জিন নামে পরিচিত। মেন্ডেলের লম্বা ও খাটো উদ্ভিদের পরীক্ষায় F1 বংশধরের সবগুলো উদ্ভিদ লম্বা হয়েছিল কারণ উদ্ভিদের লম্বা লক্ষণের অ্যালিলটি ছিল প্রকট। অপরদিকে যে জিনটি জীবের ফিনোটাইপে প্রকাশিত হয় না তাকে প্রচ্ছন্ন জিন বলে। আগের উদাহরণে সেটি ছিল খাটো উদ্ভিদের জিন।

মেন্ডেল-এর মতবাদ

মেন্ডেল নিজে কোনো মতবাদ প্রবর্তন করেননি, তিনি শুধু তাঁর গবেষণাপত্রে সংকরায়ন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের তত্ত্বীয় ও পরিসংখ্যানিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কার্ল করেন্স, যিনি পরবর্তীতে মেন্ডেলের গবেষণার পুনরাবিষ্কার প্রকাশ করেছিলেন, মেন্ডেলের আবিষ্কারকে বংশগতির 
মৌলিক দুটি সূত্র হিসেবে উপস্থাপনের যোগ্য বলে প্রচার করেন। যেহেতু সূত্রদুটি মেন্ডেলের গবেষণার উপর ভিত্তি করে রচিত, তাই সূত্রদুটি মেন্ডেলের সূত্র নামে পরিচিত। উল্লেখ্য যে মেন্ডেলের সময় আধুনিক জিনতত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়নি বলে জিনের ভূমিকাটিকে ফ্যাক্টর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। নিচে মেন্ডেল-এর সূত্র দুটি বর্ণনা করা হলো ।

মেন্ডেলের প্রথম সূত্র বা পৃথকীকরণ সূত্র (Law of Segregation) সূত্র :

সংকর (hybrid) জীবে বিপরীত লক্ষণের ফ্যাক্টরগুলো (জিনগুলো) মিশ্রিত বা পরিবর্তিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং জননকোষ সৃষ্টির সময় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়।

আধুনিক জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা: 

আমরা এই এখন সূত্র দিয়ে মেন্ডেলের লম্বা ও খাটো বৃক্ষের সংকারয়নের বেলায় F2 বংশধরের ৩:১ অনুপাতকে ব্যাখ্যা করতে পারব।

ধরে নিই, লম্বা (tall ) মটরশুঁটির জন্য দায়ী জিন = T এবং খাটো মটরশুঁটির জন্য দায়ী জিন = t; কাজেই
হোমোজাইগাস বা বিশুদ্ধ লম্বা মটরশুঁটি গাছের অ্যালিল দুটি হবে TT এবং বিশুদ্ধ খাটো মটরশুঁটি গাছের অ্যালিল দুটি হবে tt, আগের মত আমরা ধরে নিই F1 হচ্ছে প্রথম বংশধর এবং F2 দ্বিতীয় বংশধর। বিশুদ্ধ লম্বা (TT) মটরশুঁটি গাছের সাথে অপর একটি বিশুদ্ধ খাটো 
মটরশুঁটি গাছের (tt) সংকরায়ণ ঘটালে দুটি গাছের পরাগায়নের সময় লম্বা গাছের T অ্যালিল খাটো গাছের t অ্যালিলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অপত্য গাছের অ্যালিলদুটি হবে Tt। যেহেতু লম্বা গাছের অ্যালিল T প্রকট গুণসম্পন্ন তাই F1, বংশধরের সকল অপত্য মটরশুঁটি গাছের কান্ড 
হবে লম্বা। উভয় জিন দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকলেও বিনষ্ট বা একীভূত হয়ে যায় না বরং স্বকীয়তা বজায় রেখে অক্ষুন্ন থাকে।F1 বংশধরের গাছগুলো নিজেদের ভেতর পরাগায়ন করা হলে F2 বংশধরের সম্ভাব্য জিনোটাইপগুলো হবে TT, Tt, tT এবং tt (ছবি দ্রষ্টব্য)। T প্রকট অ্যালিল হওয়ার কারণে TT, Tt, tT গাছগুলো হবে লম্বা এবং tt গাছটি হবে খাটো। অন্যভাবে বলা যায়  ফিনোটাইপের ভিত্তিতে F2 বংশধরের মাঝে লম্বা এবং খাটো গাছের অনুপাত যথাক্রমে ৩:১| F2 বংশধরের সদস্যদের জিনোটাইপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ৩টি প্রকট লক্ষণধারী (লম্বা) গাছের মধ্যে মাত্র ১টি হোমোজাইগাস (TT),
বাকি দুটি হেটারোজাইগাস (Tt, tT)। যে প্রচ্ছন্ন লক্ষণটি (t) F1 বংশধরে অপ্রকাশিত ছিল, F2 বংশধরে তার প্রকাশ ঘটেছে (tt)। একইভাবে, যে শুদ্ধ প্রকট লক্ষণটি (TT), F1 বংশধরে অনুপস্থিত ছিল, সেটিও F2 বংশধরে ফিরে এসেছে। এ থেকেই প্রমাণ হয় যে প্রথম F1 বংশধরে T ও t একসঙ্গে থাকলেওপরস্পরের স্বকীয়তা বিনষ্ট হয়নি বরং গ্যামেট সৃষ্টির সময় পৃথক হয়ে গেছে।

মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র বা স্বাধীনভাবে মিলনের সূত্র (Law of Independent Assortment) সূত্র :

দুই বা ততোধিক জোড়া বিপরীত লক্ষণ বিশিষ্ট গাছের মধ্যে সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম বংশধরে (F1) কেবল প্রকট লক্ষণগুলোই প্রকাশিত হবে, কিন্তু জননকোষ সৃষ্টির সময় লক্ষণগুলো জোড়া ভেঙ্গে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জননকোষে প্রবেশ করবে।

আধুনিক জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা: 

এ সূত্র প্রমাণের জন্য মেন্ডেল দুজোড়া বিপরীতধর্মী লক্ষণসম্পন্ন উদ্ভিদের মধ্যে পরাগসংযোগ ঘটান। এমন দুটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত (হোমোজাইগাস) মটরশুঁটি গাছ নেওয়া হলো যার একটি গোল ও হলুদ বর্ণের বীজ এবং অন্যটি কুঞ্চিত ও সবুজ বর্ণের বীজ উৎপাদনে সক্ষম ।

ধরা যাক, হলুদ লক্ষণের জিনের প্রতীক = Y (বড় অক্ষরের), 

সবুজ লক্ষণের জিনের প্রতীক = y (ছোট অক্ষরের),

বীজের গোল লক্ষণের জিনের প্রতীক = R, 

কুঞ্চিত লক্ষণের জিনের প্রতীক = r, 

এবং আগের মত প্রথম বংশধর F1, দ্বিতীয় বংশধর = F2 ।

মেন্ডেল-এর মতে, প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যের জন্য দুটি করে জিন দায়ী। অতএব প্রতি জিনের জন্য দুটি করে অ্যালিল হিসেবে হলুদ (YY) বর্ণের ও গোল (RR) বীজযুক্ত উদ্ভিদের জিনোটাইপ হবে YYRR এবং সবুজ (yy) ও কুঞ্চিত (rr) বর্ণের বীজযুক্ত উদ্ভিদের জিনোটাইপ হবে yyrr। কাজেই শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত দুইটি বীজের আকার এবং বর্ণের জন্য দুটি ভিন্ন গাছের সংকারায়ন করে যে অপত্য গাছ পাওয়া যাবে তার F1 

বংশধরের জিনোটাইপ হবে YyRr। যেহেতু হলুদ বর্ণের (Y) এবং গোলাকার (R) অ্যালিল, সবুজ (y) এবং কুঞ্চিত (r) বর্ণের অ্যালিলের উপর প্রকট তাই F1 বশধরের সবগুলো গাছের বীজ হবে গোলাকৃতির এবং হলুদ বর্ণের।দ্বিতীয় সংকরায়নের সময় F1 বংশধরের পুং ও স্ত্রী জনকোষ হতে পারে YR, Yr, yR এবং এগুলি পরাগায়নের মাধ্যমে মিলিত হয়ে ৪ x ৪ = ১৬ ধরণের জিনোটাইপ তৈরি করতে পারে (ছবি দ্রষ্টব্য)। এরমাঝে গোল-হলুদ, কুঞ্চিত-হলুদ, গোল-সবুজ এবং কুঞ্চিত-সবুজ এই চার 
ধরনের ফিনোটাইপ হওয়া সম্ভব। যেহেতু গোলাকার (R) এবং হলুদ বর্ণের (Y) অ্যালিল, কুঞ্চিত (r) এবং সবুজ (y) বর্ণের অ্যালিলের উপর প্রকট তাই আমরা দেখতে পাই ১৬ ধরণের জিনোটাইপের ভেতর ফিনোটাইপ গোল-হলুদ ৯ বার, কুঞ্চিত-হলুদ ৩ বার, গোল-সবুজ ৩ বার এবং কুঞ্চিত-সবুজ ১ বার পাওয়া যায়। অর্থাৎ এদের অনুপাত ৯:৩:৩:১, ঠিক যেমনটি মেন্ডেল দেখেছিলেন।

জিনতত্ত্বও ও বংশগতিবিদ্যার সম্পর্ক

ইতোমধ্যেই তোমরা জেনেছ যে বংশগতি বা হেরিডিটি (Heredity) হলো বাবা-মা হতে বংশানুক্রমে সন্তান-সন্ততিতে জিনগত বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়া। এর ফলে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জীববিজ্ঞানের জিনতত্ত্ব (Genetics) শাখায় বংশগতি সম্পর্কিত নানাবিধ বিষয়াদির বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা করা হয়। বিজ্ঞানী উইলিয়াম বেটসন (William Bateson) ১৯০৬ 
সালে প্রথম Genetics শব্দটি ব্যবহার করেন যা গ্রিক শব্দ Gen থেকে উদ্ভূত যার ইংরেজি অর্থ to become বা to grow into ।স্যার গ্রেগর জোহান মেন্ডেল কে জিনতত্ত্বের জনক বলা হয়।
মেণ্ডেল তাঁর সংকরায়ণ পরীক্ষার ফল থেকে বুঝতে পারেন যে কোনো জীবের প্রতিটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটি উপাদান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। এ উপাদান জীবদেহে জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে এবং হ্যাপ্লয়েড গ্যামেট গঠনকালে ঐ উপাদান সংখ্যায় অর্ধেক হয়ে যায়। কিন্তু উপাদানটি কী, গ্যামেটের কোথায় এটি অবস্থিত এবং এসব উপাদান কীভাবে বংশপরস্পরায় বৈশিষ্ট্যগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে—এসব বিষয়ে মেন্ডেল অবগত ছিলেন না। ১৯০০ সালে মেণ্ডেল তত্ত্বের পুনরাবিষ্কারের পর ক্রোমোজোম ও মেন্ডেলের উপাদানের মধ্যে বেশ কিছু মিল দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ক্রোমোজোমের আকৃতি ও দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা এবং দেহকোষে সেগুলো জোড়ায় জোড়ায় থাকে। জোড়ার একটি পিতার কাছ থেকে, অপরটি মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। মানুষের বেলায় দেহকোষের ৪৬টি ক্রোমোজোমের ২৩টি আসে পিতার কাছ থেকে, বাকি ২৩টি মায়ের কাছ থেকে। শধু শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মধ্যে ৪৬টি বা ২৩ জোড়ার পরিবর্তে ২৩টি ক্রোমোজোম থাকে। এই দুটি কোষের মিলনে ৪৬টি ক্রোমোজোম নিয়ে জাইগোট কোষের সৃষ্টি হয়, যেটি কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ জীবে পরিণত হয়।মেন্ডেল একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য একজোড়া উপাদানের কথা বলেছিলেন, যার একটি পিতা ও একটি মাতার কাছ থেকে আসে, যেমনটি ক্রোমোজোমের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। ১৯০২ সালে বিজ্ঞানী সাটন (S. W. Sutton) ও বোভেরি (T. Bovery) পৃথকভাবে ক্রোমোজোম ও মেণ্ডেলের উপাদানের মধ্যে মিলের কথাটি সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেন। এ নিয়ে প্রায় এক যুগ ধরে বিভিন্ন জীব-জন্তুর উপর 
গবেষণা চলেছে। পরে দেখা গেল যে মেন্ডেলের উপাদান বা জিনের অবস্থান ক্রোমোজোমে, তাই বংশানুক্রমিক গতিপ্রকৃতির বিষয়ে ক্রোমোজোম আর উপাদানের মধ্যে এত সাদৃশ্য। গবেষণার ফলাফল থেকে তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে জিন ও ক্রোমোজোম অনেক দিক দিয়ে একই রকম আচরণ করে। তা ছাড়া বংশগতি নির্ধারণের সময় জিন ও ক্রোমোজোম সমান্তরাল আচরণ প্রদর্শন করে। 
একেই বংশগতির ক্রোমোজোম তত্ত্ব বলা হয়।



অর্ডিনেট আইটির আইসিটি(HSC) সকল কোর্সের ফ্রি ভিডিও ক্লাস

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনেট আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url