এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ-৩

 পাঠ-৩

সিরাজউদ্দৌলা

  সিকান্দার আবু জাফর

পাঠভিত্তিক উদ্দেশ্য

এ পাঠটি পড়ে তুমি-

  • প্রজাদের প্রতি নবাব সিরাজউদ্দৌলার গভীর ভালোবাসার কথা বর্ণনা করতে পারবে;
  • প্রজাদের উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের বিবরণ প্রদান করতে পারবে;
  • সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রের কতিপয় বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে পারবে;
  • সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে তাঁর সভাসদ এবংকোম্পানির প্রতিনিধি মি. ওয়াট্সের মনোভাব লিপিবদ্ধ করতে পারবে;
  • সিরাজউদ্দৌলার সভাসদদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে পারবে। 

আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র নাটক :সিরাজউদ্দৌলা 

এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ ১

এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: বাংলা ১ম পত্র নাটক সিরাজউদ্দৌলা সিকান্দার আবু জাফর(Admission Test)

দ্বিতীয় অংক: প্রথম দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ১০ মার্চ। স্থান : নবাবের দরবার।

[চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- নকিব, সিরাজ, রাজবল্লভ, মিরজাফর, জগৎশেঠ,রায়দুর্লভ, উৎপীড়িত ব্যক্তি, প্রহরী ওয়াটস, মোহনলাল।]

(দরবারে উপস্থিত- মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ এবং ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াটস। মোহনলাল, মিরমর্দান, সাঁফ্রে অস্ত্রসজ্জিত বেশে দন্ডায়মান। নকিবের কণ্ঠে দরবারে নবাবের আগমন ঘোষিত হলো)।


নকিব : নবাব মনসুর-উল-মুলুক সিরাজউদ্দৌলা শাহকুলি খাঁ মির্জা মুহম্মদ হায়বতজঙ্গ বাহাদুর। বা-আদাব আগাহ বাশেদ।

 (সবাই আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল। দৃঢ় পদক্ষেপে নবাব ঢুকলেন। সবাই নতশিরে শ্রদ্ধা জানালো।)

সিরাজ : (সিংহাসনে আসীন হয়ে) আজকের এই দরবারে আপনাদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে কয়েকটি জরুরি বিষয়ের মীমাংসার জন্যে।

রাজবল্লভ : বে-আদবি মাফ করবেন জাঁহাপনা। দরবারে এ পর্যন্ত তেমন কোনো জরুরি বিষয়ের মীমাংসা হয়নি। তাই আমরা তেমন-

সিরাজ : গুরুতর কোনো বিষয়ের মীমাংসা হয়নি এই জন্যে যে, গুরুতর কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এমন আশঙ্কা আমার ছিল না। আমার বিশ্বাস ছিল যে, সিপাহসালার মিরজাফর, রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ থাকবেন। আমার পথ বিঘ্ন সঙ্কুল হয়ে উঠবে না। অন্তত নবাব আলিবর্দির অনুরাগজনদের কাছ থেকে আমি তাই আশা করেছিলাম।

মিরজাফর : জাঁহাপনা কি আমাদের আচরণে সন্দেহ প্রকাশ করছেন? 

সরাজ : আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবার কোনো বাসনা আমার নেই। আমার নালিশ আজ আমার নিজের বিরুদ্ধে। বিচারক আপনারা। বাংলার প্রজা সাধারণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করতে পারিনি বলে আমি তাদের কাছে অপরাধী। আজ সেই অপরাধের জন্যে আপনাদের কাছে আমি বিচারপ্রার্থী।

জগৎশেঠ : আপনার অপরাধ।

সিরাজ : পরিহাস বলে মনে হচ্ছে শেঠজি? চেয়ে দেখুন এই লোকটার দিকে (ইঙ্গিত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রহরী একজন হতশ্রী ব্যক্তিকে দরবারে হাজির করল। সে ডুকরে কেঁদে উঠল।)

রায়দুর্লভ : একি! এর এই অবস্থা কে করলে? (তরবারি নিষ্কাশন)

সিরাজ : তরবারি কোষবদ্ধ করুন রায়দুর্লভ! এর এই অবস্থার জন্যে দায়ী সিরাজের দুর্বলশাসন।

উৎপীড়িত : আমাকে শেষ করে দিয়েছে হুজুর।

মিরজাফর : আমরা যে কিছুই বুঝতে পারছিনে জাঁহাপনা।

উৎপীড়িত : লবণ বিক্রি করিনি বলে কুঠির সাহেবদের লোকজন আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে (ক্রন্দন)

সিরাজ : (সিংহাসনের হাতলে ঘুষি মেরে) কেঁদনা। শুকনো খটখটে গলায় বলো আর কী হয়েছে। আমি দেখতে চাই, আমার রাজত্বে হৃদয়হীন জালিমের বিরুদ্ধে অসহায় মজলুম কঠিনতর জালিম হয়ে উঠছে।

উৎপীড়িত : লবণ বিক্রি করিনি বলে কুঠির সাহেবদের লোকজন আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। ষন্ডা ষন্ডা পাঁচজনে মিলে আমার পোয়াতি বউটাকে- ওহ্ হো হো (কান্না)- আমি দেখতে চাইনি। কিন্তু চোখ বুজলেই ওদের আর একজন আমার নখের ভেতরে খেজুর কাঁটা ফুটিয়েছে। আমার বউকে ওরা খুন করে ফেলেছে হুজুর।

                                                                                                                            (কান্নায় ভেঙে পড়ল)

সিরাজ : (হঠাৎ আসন ত্যাগ করে ওয়াটসের কাছে গিয়ে প্রবল কণ্ঠে) ওয়াটস!

ওয়াটস : (ভয়ে বিবর্ণ) Your Excellency.

সিরাজ : আমার নিরীহ প্রজাটির এই দুরবস্থার জন্যে কে দায়ী?

ওয়াটস : How can I know that your Excellency?

সিরাজ : তুমি কী করে জানবে? তোমাদের অপকীর্তির কোনো খবর আমার কাছে পৌঁছায় না ভেবেছো? কুঠিয়াল ইংরেজরা এমনি করে দৈনিক কতগুলো নিরীহ প্রজার ওপর অত্যাচার করে তার হিসেব দাও।

ওয়াটস : আপনি আমায় অপমান করছেন Your Excellency. দেশের কোথায় কী হচ্ছে সে কৈফিয়ত আমি দেবো কী করে? আমি তো আপনার দরবারে কোম্পানির প্রতিনিধি।

সিরাজ : তুমি প্রতিনিধি? ড্রেক এবং তোমার পরিচয় আমি জানিনে ভেবেছো? দুশ্চরিত্রতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার জন্যে দেশ থেকে নির্বাসিত না করে ভারতে বাণিজ্যের জন্য তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তাই এ দেশে বাণিজ্য করতে এসে দুর্নীতি এবং অনাচারের পথ তোমরা ত্যাগ করতে পারনি। কৈফিয়ৎ দাও, আমার নিরীহ প্রজাদের ওপর এই জুলুম কেন?

ওয়াটস : আপনার প্রজাদের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক। আমরা ট্যাক্স দিয়ে শান্তিতে বাণিজ্য করি।

সিরাজ : ট্যাক্স দিয়ে বাণিজ্য করো বলে আমার নিরীহ প্রজার ওপরে অত্যাচার করবার অধিকার তোমরা পাওনি।

ওমর খৈয়াম (১৯৬৬), সিংয়ের নাটক (১৯৭১)। 

আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র নাটক :সিরাজউদ্দৌলা 

এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: বাংলা ১ম পত্র নাটক সিরাজউদ্দৌলা সিকান্দার আবু জাফর(Admission Test)

                                           (সমবেত সকলকে উদ্দেশ্য করে)

 এই লোকটি লবণ প্রস্তুতকারক। লবণের ইজারাদার কুঠিয়াল ইংরেজ। স্থানীয় লোকদের তৈরি যাবতীয় লবণ তারা তিন চার আনা মণ দরে পাইকারি হিসেবে কিনে নেয়। তারপর এখানে বসেই এখানকার লোকের কাছে সেই লবণ বিক্রি করে দুটাকা আড়াই টাকা মণ দরে।

মিরজাফর : এ তো ডাকাতি।

সিরাজ : আপনাদের পরামর্শেই আমি কোম্পানিকে লবণের ইজারাদারি দিয়েছি। আপনারা আমাকে বুঝিয়েছিলেন রাজস্বের পরিমাণ বাড়লে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড মজবুত হয়ে উঠবে। কিন্তু এই কি তার প্রমাণ? এই লোকটি কুঠিয়াল ইংরেজদের কাছে পাইকারি দরে লবণ বিক্রি করতে চায়নি বলে তার এই অবস্থা। বলুন শেঠজি, বলুন রাজবল্লভ, ব্যক্তিগত অর্থলালসায় বিচারবুদ্ধি হারিয়ে আমি এই কুঠিয়ালদের প্রশ্রয় দিয়েছি কি-না? বলুন সিপাহসালার, বলুন রায়দুর্লভ, আমি এই অনাচারীদের বিরুদ্ধে শাসন-শক্তি প্রয়োগ করবার সদিচ্ছা দেখিয়েছি কিনা? বিচার করুন। আপনাদের কাছে আজ আমি আমার অপরাধের বিচারপ্রার্থী। 

                                                                                    (প্রহরী উৎপীড়িত লোকটিকে বাইরে নিয়ে গেল)

রাজবল্লভ : জাঁহাপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না। কিন্তু প্রকাশ্য দরবারে এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনায় আমাদের অপমান না করলেও চলত।

জগৎশেঠ : নবাবের কাছে আমাদের পদমর্যাদার কোনো মূল্যই নেই। তাই-সিরাজ : আপনারাও সবাই মিলে নবাবের মর্যাদা যে কোনো মূল্যে বিক্রি করে দিতে চান এই তো?

মিরজাফর : এ-কথা বলে নবাব আমাদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রের অভিযোগ আনতে চাইছেন। এই অযথা দুর্ব্যবহার আমরা হৃষ্ট মনে গ্রহণ করতে পারব কি না সন্দেহ।

সিরাজ : বাংলার নবাবকে ভয় দেখাচ্ছেন সিপাহসালার? দরবারে বসে নবাবের সঙ্গে কী রকম আচরণ করা বিধেয় তাও আপনার স্মরণ নেই? এই মুহূর্তে আপনাকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব আমি নিজে গ্রহণ করতে পারি। জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ সবাইকে কয়েদখানায় আটক রাখতে পারি। হ্যাঁ কোনো দুর্বলতা নয়। শত্রুর কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে আমাকে তাই করতে হবে। মোহনলাল।

                                                                                                    (মোহনলাল তরবারি নিষ্কাশন করল)

সিরাজ : (হাতের ইঙ্গিতে মোহনলালকে নিরস্ত করে শান্তভাবে) না, আমি তা করব না। ধৈর্য ধরে থাকব। অসংখ্য ভুল বোঝাবুঝি, অসংখ্য ছলনা এবং শাঠ্যের ওপর আমাদের মৌলিক সম্প্রীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজ সন্দেহেরও কোনো অবকাশ রাখব না।

মিরজাফর : আমাদের প্রতি নবাবের সন্ধিগ্ধ মনোভাবের পরিবর্তন না হলে দেশের কল্যাণের কথা ভেবে আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠব।

সিরাজ : ওই একটি পথ সিপাহসালার- দেশের কল্যাণ, দেশবাসীর কল্যাণ। শুধু ওই একটি পথেই আবার আমরা উভয়ে উভয়ের কাছাকাছি আসতে পারি। আমি জানতে চাই, সেই পথে আপনারা আমার সহযাত্রী হবেন কি না?

রাজবল্লভ : জাঁহাপনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট জানা দরকার।

সিরাজ : আমার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট নয়। কলকাতায় ওয়াটস এবং ক্লাইভ আলিনগরের সন্ধি খেলাপ করে, আমার আদেশের বিরুদ্ধে ফরাসি অধিকৃত চন্দননগর আক্রমণ করেছে। তাদের ঔদ্ধত্য বিদ্রোহের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখুনি এর প্রতিবিধান করতে না পারলে ওরা একদিন আমাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হস্তক্ষেপ করবে।

মিরজাফর : জাঁহাপনা আমাদের হুকুম করুন।

সিরাজ : আমি অন্তহীন সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ভরসা নিয়েই আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। তবু বলছি আপনারা ইচ্ছে করলে আমাকে ত্যাগ করতে পারেন। বোঝা যতই দুর্বহ হোক আমি একাই তা বইবার চেষ্টা করব। শুধু আপনাদের কাছে আমার একমাত্র অনুরোধ যে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আপনারা আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না।

মিরজাফর : দেশের স্বার্থের জন্যে নিজেদের স্বার্থ তুচ্ছ করে আমরা নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব।

সিরাজ : আমি জানতাম দেশের প্রয়োজনকে আপনারা কখনও তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না।

 (সিরাজের ইঙ্গিতে প্রহরী তাঁর হাতে কোরান শরিফ দিল। সিরাজ দুহাতে সেটা নিয়ে চুমু খেয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর মিরজাফরের দিকে এগিয়ে দিলেন। মিরজাফর নতজানু হয়ে দুহাতে পবিত্র কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন।)

মিরজাফর : আমি আল্লাহর পাক কালাম ছুঁয়ে ওয়াদা করছি, আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব।

 (সিরাজ প্রহরীর হাতে কোরান শরীফ সমর্পণ করলেন এবং অপর প্রহরীর হাত থেকে তামা, তুলসী, গঙ্গাজলের পাত্র গ্রহণ করলেন। তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে একে একে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ নিজের নিজের প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করে গেলেন)।

রাজবল্লভ : আমি রাজবল্লভ, তামাতুলসী গঙ্গাজল ছুঁয়ে ঈশ্বরের নামে শপথ করছি, আমার জীবন নবাবের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত।

রায়দুর্লভ : ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করছি, সর্বশক্তি নিয়ে চিরকালের জন্যে আমি নবাবের অনুগামী।

উমিচাঁদ : রামজিকি কসম, ম্যায় কোরবান হুঁ নওয়াবকে লিয়ে।(প্রহরী উৎপীড়িত লোকটিকে বাইরে নিয়ে গেল)

রাজবল্লভ : জাঁহাপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না। কিন্তু প্রকাশ্য দরবারে এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনায় আমাদের অপমান না করলেও চলত।

জগৎশেঠ : নবাবের কাছে আমাদের পদমর্যাদার কোনো মূল্যই নেই। তাই-

সিরাজ : আপনারাও সবাই মিলে নবাবের মর্যাদা যে কোনো মূল্যে বিক্রি করে দিতে চান এই তো?

মিরজাফর : এ-কথা বলে নবাব আমাদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রের অভিযোগ আনতে চাইছেন। এই অযথা দুর্ব্যবহার আমরা হৃষ্ট মনে গ্রহণ করতে পারব কি না সন্দেহ।

সিরাজ : বাংলার নবাবকে ভয় দেখাচ্ছেন সিপাহসালার? দরবারে বসে নবাবের সঙ্গে কী রকম আচরণ করা বিধেয় তাও আপনার স্মরণ নেই? এই মুহূর্তে আপনাকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব আমি নিজে গ্রহণ করতে পারি। জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ সবাইকে কয়েদখানায় আটক রাখতে পারি। হ্যাঁ কোনো দুর্বলতা নয়। শত্রæর কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে আমাকে তাই করতে হবে। মোহনলাল।

                                                                                                 (মোহনলাল তরবারি নিষ্কাশন করল)

সিরাজ : (হাতের ইঙ্গিতে মোহনলালকে নিরস্ত করে শান্তভাবে) না, আমি তা করব না। ধৈর্য ধরে থাকব। অসংখ্য ভুল বোঝাবুঝি, অসংখ্য ছলনা এবং শাঠ্যের ওপর আমাদের মৌলিক সম্প্রীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজ সন্দেহেরও কোনো অবকাশ রাখব না।

মিরজাফর : আমাদের প্রতি নবাবের সন্ধিগ্ধ মনোভাবের পরিবর্তন না হলে দেশের কল্যাণের কথা ভেবে আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠব।

সিরাজ : ওই একটি পথ সিপাহসালার- দেশের কল্যাণ, দেশবাসীর কল্যাণ। শুধু ওই একটি পথেই আবার আমরা উভয়ে উভয়ের কাছাকাছি আসতে পারি। আমি জানতে চাই, সেই পথে আপনারা আমার সহযাত্রী হবেন কি না?

রাজবল্লভ : জাঁহাপনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট জানা দরকার।

সিরাজ : আমার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট নয়। কলকাতায় ওয়াটস এবং ক্লাইভ আলিনগরের সন্ধি খেলাপ করে, আমার আদেশের বিরুদ্ধে ফরাসি অধিকৃত চন্দননগর আক্রমণ করেছে। তাদের ঔদ্ধত্য বিদ্রোহের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখুনি এর প্রতিবিধান করতে না পারলে ওরা একদিন আমাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হস্তক্ষেপ করবে।

মিরজাফর : জাঁহাপনা আমাদের হুকুম করুন।

সিরাজ : আমি অন্তহীন সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ভরসা নিয়েই আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। তবু বলছি আপনারা ইচ্ছে করলে আমাকে ত্যাগ করতে পারেন। বোঝা যতই দুর্বহ হোক আমি একাই তা বইবার চেষ্টা করব। শুধু আপনাদের কাছে আমার একমাত্র অনুরোধ যে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আপনারা আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না।

মিরজাফর : দেশের স্বার্থের জন্যে নিজেদের স্বার্থ তুচ্ছ করে আমরা নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব।

সিরাজ : আমি জানতাম দেশের প্রয়োজনকে আপনারা কখনও তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না।

 (সিরাজের ইঙ্গিতে প্রহরী তাঁর হাতে কোরান শরিফ দিল। সিরাজ দুহাতে সেটা নিয়ে চুমু খেয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর মিরজাফরের দিকে এগিয়ে দিলেন। মিরজাফর নতজানু হয়ে দুহাতে পবিত্র কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন।)

মিরজাফর : আমি আল্লাহর পাক কালাম ছুঁয়ে ওয়াদা করছি, আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব।

 (সিরাজ প্রহরীর হাতে কোরান শরীফ সমর্পণ করলেন এবং অপর প্রহরীর হাত থেকে তামা, তুলসী, গঙ্গাজলের পাত্র গ্রহণ করলেন। তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে একে একে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ নিজের নিজের প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করে গেলেন)।

রাজবল্লভ : আমি রাজবল্লভ, তামাতুলসী গঙ্গাজল ছুঁয়ে ঈশ্বরের নামে শপথ করছি, আমার জীবন নবাবের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত।

রায়দুর্লভ : ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করছি, সর্বশক্তি নিয়ে চিরকালের জন্যে আমি নবাবের অনুগামী।

উমিচাঁদ : রামজিকি কসম, ম্যায় কোরবান হুঁ নওয়াবকে লিয়ে।

সিরাজ : (ওয়াটসকে) ওয়াসটস।

ওয়াটস :Your Excellency.

সিরাজ : আলিনগরের সন্ধির শর্ত অনুসারে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে দরবারে তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। সেই সম্মানের অপব্যবহার করে এখানে বসে তুমি গুপ্তচরের কাজ করছো। তোমাকে সাজা না দিয়েই ছেড়ে দিচ্ছি। বেরিয়ে যাও দরবার থেকে। ক্লাইভ আর ওয়াটসকে গিয়ে সংবাদ দাও যে, তাদের আমি উপযুক্ত শিক্ষা দেব। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেইমান নন্দকুমারকে ঘুষ খাইয়ে তারা চন্দননগর ধ্বংস করেছে। এই ঔদ্ধত্যের শাস্তি তাদের যথাযোগ্যভাবেই দেওয়া হবে।

ওয়াটস : Your Excellency. 


                   দ্বিতীয় অংক: দ্বিতীয় দৃশ্য

                            সময় : ১৭৫৭ সাল, ১৯ মে। স্থান : মিরজাফরের আবাস।

[চরিত্রবৃন্দ মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- জগৎশেঠ, মিরজাফর, রাজবল্লভ, রাইসুল জুহালা, প্রহরী]

(মন্ত্রণাসভায় উপস্থিত--মিরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ) 


জগৎশেঠ : সিপাহসালার বড় বেশি হতাশ হয়েছেন।

মিরজাফর : না শেঠজি, হতাশ হবার প্রশ্ন নয়। আমি নিস্তব্ধ হয়েছি। অগ্নিগিরির মতো প্রচন্ড গর্জনে ফেটে পড়বার জন্যে তৈরি হচ্ছি । বুকের ভেতর আকাক্সক্ষা আর অধিকারের লাভা টগবগ করে ফুটে উঠছে ঘৃণা আর বিদ্বেষের অসহ্য উত্তাপে। এবার আমি আঘাত হানবোই।

রাজবল্লভ : প্রকাশ্য দরবারে এতবড় অপমানের কথা আমি কল্পনাও করিনি।

মিরজাফর : শুধু অপমান! প্রাণের আশঙ্কায় সে আমাদের আতঙ্কিত করে তোলেনি? পদস্থ কেউ হলে মানীর মর্যাদা বুঝত। কিন্তু মোহনলালের মতো সামান্য একটা সিপাই যখন তলোয়ার খুলে সামনে দাঁড়াল তখন আমার চোখে কেয়ামতের ছবি ভেসে উঠেছিল।

রায়দুর্লভ : সিপাহসালারের অপমানটাই আমার বেশি বেজেছে।

মিরজাফর : এখন আপনারা সবাই আশা করি বুঝতে পারছেন যে, সিরাজ আমাদের স্বস্তি দেবে না।

জগৎশেঠ : তা দেবে না। চতুর্দিকে বিপদ, তা সত্তে¡ও সে আমাদের বন্দি করতে চায়। এরপর সিংহাসনে স্থির হতে পারলে তো কথাই নেই।

রাজবল্লভ : আমাদের অস্তিত্বই সে লোপ করে দেবে। আমাদের সম্বন্ধে যতটুকু সন্দেহ নবাবের বাইরের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ পায়নি তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। শওকতজঙ্গের ব্যাপারে নবাব আমাদের কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। শুধু মোহনলালের অধীনে সৈন্য পাঠিয়ে তাকে বিনাশ করেছে। এতে আমাদের নিশ্চিন্ত হবার কিছুই নেই।

জগৎশেঠ : তার প্রমাণ তো রয়েছে হাতের কাছে। আমাদের গ্রেফতার করতে গিয়েও করেনি। কিন্তু রাজা মানিকচাঁদকে তো ছাড়ল না। তাকে তো কয়েদখানায় যেতে হল। শেষ পর্যন্ত দশ লক্ষ টাকা খেসারত দিয়ে তবে তার মুক্তি। আমি দেখতে পাচ্ছি নন্দকুমারের অদৃষ্টেও বিপদ ঘনিয়ে এসেছে।

মিরজাফর : আমাদের কারও অদৃষ্ট মেঘমুক্ত থাকবে না শেঠজি।

রাজবল্লভ : আমি ভাবছি তেমন দুঃসময় যদি আসে, আর মূল্য দিয়ে মুক্তি কিনবার পথটাও যদি খোলা থাকে, তা হলেও সে মূল্যের পরিমাণ এত বিপুল হবে যে আমরা তা বইতে পারব কিনা সন্দেহ। মানিকচাঁদের মুক্তিমূল্য যদি দশ লক্ষ টাকা হয়ে থাকে তা হলে জগৎশেঠের মুক্তিমূল্য পঞ্চাশ কোটি টাকার কম হবে না।

জগৎশেঠ : ওরে বাবা! তার চেয়ে গলায় পা দিয়ে বুকের ভেতর থেকে কলজেটাই টেনে বার করে আনুক। পঞ্চাশ কোটি? আমার যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করেও এক কোটি টাকা হবে না। ধরতে গেলে মাসের খরচটাইতো  ওঠে না। নবাবের হাত থেকে ধন সম্পদ রক্ষার জন্যে মাসে অজস্র টাকা খরচ করে সেনাপতি ইয়ার লুৎফ খাঁয়ের অধীনে দুহাজার অশ্বারোহী পুষতে হচ্ছে।

মিরজাফর : কাজেই আর কালক্ষেপ নয়।

রাজবল্লভ : আমরা প্রস্তুত। কর্মপন্থা আপনিই নির্দেশ করুন। আমরা একবাক্যে আপনাকেই নেতৃত্ব দিলাম।

মিরজাফর : আমার ওপরে আপনাদের আন্তরিক ভরসা আছে তা আমি জানি। তবু আজ একটা বিষয় খোলসা করে নেওয়া উচিত। আজ আমরা সবাই সন্দেহ-দোলায় দুলছি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি নে। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত কাগজে কলমে পাকাপাকি করে নেওয়াই আমার প্রস্তাব।

জগৎশেঠ : আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।

রায়দুর্লভ : এতে আপত্তির কী থাকতে পারে?

                                                                                     (নেপথ্যে কন্ঠস্বর)

নেপথ্যে : ওরে বাবা কতবার করে দেখাতে হবে? দেউড়ি থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত মোট একুশ বার দেখিয়েছি। এই দেখো বাবা, আর একটিবার দেখো। হলো তো?

                                                                                         (রাইসুল জুহালা কামরায় ঢুকলেন)

 কী গেরোরে বাবা।

মিরজাফর : কী হয়েছে?

রাইস : সালাম হুজুর। ওই পাহারাওয়ালা হুজুর। সবাই হাত বাড়িয়ে আঙুল নাচিয়ে বলে, দেখলাও। দেরি করলে তলোয়ারে হাত দেয়। আমি বলি আছে বাবা, আছে। খোদ নবাবের পাঞ্জা-

মিরজাফর : (সন্ত্রস্ত) নবাবের পাঞ্জা?

রাইস : আলবৎ হুজুর। কেন নয়? (আবার কুর্ণিশ করে) হুজুরের নবাব হতে আর বাকি কী?

মিরজাফর : (প্রসন্ন হাসি হেসে) সে যাক। খবর কী তাই বলো।

রাইস : প্রায় শেষ খবর নিয়ে এসেছিলাম হুজুর। তলোয়ারের খাড়া এক কোপ। একেবারে গর্দান সমেত-

রাজবল্লভ : (বিরক্ত) আবোল তাবোল বকে বড় বেশি সময় নষ্ট করছো রাইস মিয়া।

রাইস : (ক্ষুব্ধ) আবোল তাবোল কী হুজুর, বলছি তো তলোয়ারের খাড়া এক কোপ। লাফিয়ে সরে দাঁড়িয়ে তাই রক্ষে। তবে এই দেখুন। (পকেট থেকে দ্বিখন্ডিত মূলার নিম্নাংশ বার করল) একটু নুন জোগাড় হলেই কাঁচা খাবো বলে মূলোটা হাতে নিয়েই ঘুরছিলাম। ক্লাইভ সাহেবের তলোয়ারের কোপে সেটাই দুখন্ড ।

জগৎশেঠ : এ যে দেখি ব্যাপারটা ক্রমশ ঘোরালো করে তুলছে। ক্লাইভ সাহেব তোমাকে তলোয়ারের কোপ মারতে গেল কেন?

রাইস : গেরো হুজুর। কপালের গেরো। উমিচাঁদজির চিঠি নিয়ে তার কাছে গেলাম। তিনি চিঠি না পড়ে কটমট করে আমার দিকে চাইতে লাগলেন। তারপর ওঁর কামানের মতো গলা দিয়ে একতাল কথার গোলা ছুটে বার হলো: আর ইউ এ স্পাই? এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই প্রশ্নই বাংলায়- তুমি গুপ্তচর? এমন এক অদ্ভুত উচ্চারণ করলেন, আমি শুনলাম তুমি ঘুফুৎচোর? চোর এ কথাটা শুনেই মাথা গরম হয়ে উঠল। তা ছাড়া ঘুফুৎচোর? ছিঁচকে চোর থেকে আরম্ভ করে হাড়ি চোর, শাড়ি চোর, গামছা চোর, বদনা চোর, জুতো চোর, গরু চোর, সিঁধেল চোর, কাফন চোর। আমাদের আপনাদের ভেতরে হুজুর কত রকমারি চোরের নাম যে শুনেছি আর তাদের চেহারা চিনেছি তার আর হিসেব নেই। কিন্তু ঘুফুৎচোর? আর আমি স্বয়ং। হিতাহিত বিচার না করে হুজুর মুখের ওপরেই বলে ফেললাম, (মৃদুহাসি) একটু ইংরেজিও তো জানি, ইংরেজিতেই বললাম, ইউ শাট আপ। সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ারের এক কোপ। (হেসে উঠে) অহঙ্কার করব না হুজুর, লাফটা যা দিয়েছিলোম একবারে মাপা। তাই আমার গর্দানের বদলে ক্লাইভ সাহেবের ভাগ্যে জুটেছে মূলোর মাথাটা।

মিরজাফর : কথা থামাবে রাইস মিয়া।

রাইস : হুজুর।

মিরজাফর : এখন তুমি কার কাছ থেকে আসছ?

রাইস : উমিচাঁদজির কাছ থেকে। এই যে চিঠি। (পত্র দিল) 

মিরজাফর : (পত্র পড়ে রাজবল্লভের দিকে এগিয়ে দিলেন) ক্লাইভ সাহেবের ওখানে কাকে দেখলে?

রাইস : অনেকগুলো সাহেব মেমসাহেব হুজুর। ভূত ভ‚ত চেহারা সব।

মিরজাফর : কারো নাম জানো না?

রাইস : সব তো বিদেশি নাম। এদেশি হলে পুরুষগুলোকে বলা যেত- বেম্মোদত্যি, জটাধারী, মামদো, পেঁচো, চোয়ালে পেঁচো, গলায় দড়ে, এক ঠেংগে, কন্দকাটা ইত্যাদি। মেয়েগুলোকে বলতে পারতাম শাঁকচুন্নী, উলকামুখী, আঁষটেপেতি, কানি পিশাচী এইসব আর কী।

জগৎশেঠ : রাইস মিয়ার মুখে কথার খই ফুটছে।

রাইস : রাত-বেরাতে চলাফেরা করি, ভ‚ত-পেত্নির সঙ্গেও যোগ রাখতে হয় হুজুর।

 (চিঠিখানা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ এবং রায়দুর্লভের হাত ঘুরে আবার মিরজাফরের হাতে এলো।)

মিরজাফর : একে তাহলে বিদায় দেওয়া যাক?

রাজবল্লভ : চিঠির জবাব দেবেন না?

মিরজাফর : চিঠিপত্র যত কম দেওয়া যায় ততই ভালো। কে জানে কোথায় সিরাজের গুপ্তচর ওৎ পেতে বসে আছে।

জগৎশেঠ : তাছাড়া আমাদের গুপ্তচরদেরই বা বিশ্বাস কী? তারা মূল চিঠি হয়ত আসল জায়গায় পৌঁছচ্ছে; কিন্তু একখানা করে তার নকল যথাসময়ে নবাবের লোকের হাতে পাচার করে দিচ্ছে।

রাইস : সন্দেহ করাটা অবশ্য বুদ্ধিমানের কাজ; কিন্তু বেশি সন্দেহে বুদ্ধি ঘুলিয়ে যেতে পারে। একটা কথা মনে রাখবেন হুজুর, গুপ্তচররাও যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে। তাদের বিপদের ঝুঁকিও কম নয়।

জগৎশেঠ : কিছু মনে কোরো না। তোমার সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করিনি।

মিরজাফর : তুমি তাহলে এখন এসো। উমিচাঁদজিকে আমার এই সাংকেতিক মোহরটা দিও। তাহলেই তিনি তোমার কথা বিশ্বাস করবেন। তাঁকে বোলো, দুনম্বর জায়গায় আগামী মাসের ৮ তারিখে সব কিছু লেখাপড়া হবে।

রাইস : হুজুর! (সাংকেতিক মোহরটা নিয়ে বেরিয়ে গেল)

মিরজাফর : কত কিছুই হতে পারে শেঠজি। আমরাই কি দিনকে রাত করে তুলছিনে? নবাবের মির মুন্সি আসল চিঠি গায়েব করে নকল চিঠি পাঠাচ্ছে কোম্পানির কাছে তাতেই তো ওদের এত সহজে ক্ষেপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বুদ্ধিটা অবশ্য রাজবল্লভের; কিন্তু ভাবুন তো কতখানি দায়িত্ব এবং বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে নবাবের বিশ্বাসী মির মুন্সি।

জগৎশেঠ : তা তো বটেই। গুপ্তচরের সহায়তা ছাড়া আমরা এক পা-ও এগোতে পারতাম না।

মিরজাফর : প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন আমি ভাবছি ইংরেজদের ওপরে পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে কি না?  তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওরা বেনিয়ার জাত। পয়সা ছাড়া কিছু বোঝে না। ওরা জানে সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে কোনো রকম সুবিধার আশা নেই। কাজেই সিপাহসালারকে সিংহাসনে বসবার জন্যে ওরা সব রকমের সাহায্য দেবে।

জগৎশেঠ : অবশ্য টাকা ছাড়া। কারণ সিরাজকে গদিচ্যুত করা ওদের প্রয়োজন হলেও সিপাহসালারকে ওরা সাহায্য দেবে নগদ মূল্যের বিনিময়ে।

রাজবল্লভ : সেটাও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে কিনা তা তো বুঝতে পারছিনে। আমি যতদূর শুনেছি ওদের দাবি দুকোটি টাকার ওপরে যাবে। কিন্তু এত টাকা সিরাজউদ্দৌলার তহবিল থেকে কোনো ক্রমেই পাওয়া যাবে না।

মিরজাফর : আমরা অনেকদূর এগিয়ে এসেছি রাজা রাজবল্লভ। ওকথা আর এখন ভাবলে চলবে না। সকলের স্বার্থের খাতিরে ক্লাইভের দাবি মেটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। (বিভোর কণ্ঠে) সফল করতে হবে আমার স্বপ্ন। বাংলার মসনদ-নবাব আলিবর্দির আমলে, উদ্ধত সিরাজের আমলে মসনদের পাশে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আমি এই কথাই শুধু ভেবেছি, একটা দিন মাত্র একটা দিনও যদি ওই মসনদে মাথা উঁচু করে আমি বসতে পারতাম। 

                            দ্বিতীয় অংক: তৃতীয় দৃশ্য

                                        সময় : ১৭৫৭ সাল, ৯ জুন। স্থান : মিরনের আবাস।

[চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- নর্তকীগণ, বাদকগণ, মিরন, পরিচারিকা, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, মিরজাফর, ওয়াটস, ক্লাইভ, রক্ষী, মোহনলাল।]

(ফরাসে তাকিয়া ঠেস দিয়ে অর্ধশায়িত মিরন। পার্শ্বে উপবিষ্টা নর্তকীর হাতে ডান হাত সমর্পিত। অপর নর্তকী নৃত্যরতা। নৃত্যের মাঝে মাঝে সুরামত্ত মিরনের উল্লাসধ্বনি।] 


মিরন : সাবাস। বহোত খুব। তোমরা আছ বলেই বেঁচে থাকতে ভালো লাগে।

 (নর্তকী নাচের ফাঁকে এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিল মিরনের দিকে। পরিচারিকা কামরায় এসে চিঠি দিলো মিরনের হাতে। সেটা পড়ে বিরক্ত হলো মিরন। তবু পরিচারিকাকে সম্মতি সূচক ইঙ্গিত করতেই সে বেরিয়ে গেল। পার্শ্বে উপবিষ্টা নর্তকী মিরনের ইঙ্গিতে কামরার অন্যদিকে চলে গেল। অল্প পরেই ছদ্মবেশধারী এক ব্যক্তিকে কামরায় পৌঁছিয়ে দিয়ে পরিচারিকা চলে গেল।)

মিরন : সেনাপতি রায়দুর্লভ এ সময়ে এখানে আসবেন তা ভাবিনি। (নর্তকীদের চলে যেতে ইঙ্গিত করল)

রায়দুর্লভ : আমাকে আপনি নৃত্যগীতের সুধারসে একেবারে নিরাসক্ত বলেই ধরে নিয়েছেন।

মিরন : তা নয়, তবে আপনি যখন ছদ্মবেশে হঠাৎ এখানে উপস্থিত হয়েছেন তখুনি বুঝেছি প্রয়োজন জরুরি। তাই সময় নষ্ট করতে চাইলুম না।

রায়দুর্লভ : দুদন্ড সময় নষ্ট করে একটু আমোদ-প্রমোদই না হয় হতো। অহরহ অশান্তি আর অব্যবস্থার মধ্যে থেকে জীবন বিস্বাদ হয়ে উঠেছে। কিন্তু (একজনকে দেখিয়ে) এ নর্তকীকে আপনি পেলেন কোথায়? একে যেন এর আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। সে যাক। হঠাৎ আপনার এখানে বৈঠকের আয়োজন? তা-ও খবর পেলাম কিছুক্ষণ আগে।

মিরন : আমার এখানে না করে উপায় কী? মোহনলালের গুপ্তচর জীবন অসম্ভব করে তুলেছে। আমার বাসগৃহ অনেকটা নিরাপদ। কারণ মোহনলাল জানে যে, আমি নাচ-গানে মশগুল থাকতেই ভালবাসি।

রায়দুর্লভ : কে কে আসছেন এখানে।

মিরন : প্রয়োজনীয় সবাই। তা ছাড়া বাইরে থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আসবেন কোম্পানির প্রতিনিধি কেউ একজন।

রায়দুর্লভ : কোম্পানির প্রতিনিধি কলকাতা থেকে এখানে আসছেন?

মিরন : তিনি আসবেন কাশিম বাজার থেকে।

রায়দুর্লভ : সে যা হোক আলোচনায় আমি থাকতে পারব না। কারণ আমার পক্ষে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। কখন কী কাজে তলব করে বসবেন তার ঠিক নেই। তলবের সঙ্গে সঙ্গে হাজির না পেলে তখুনি সন্দেহ জমে উঠবে। আপনার কাছে তাই আগেভাগে এলাম শুধু আমার সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা হলো জানবার জন্যে।

মিরন : আপনার ব্যবস্থা তো পাকা। সিরাজের পতন হলে আব্বা হবেন মসনদের মালিক। কাজেই সিপাহসালারএর পদ আপনার জন্যে একবারে নির্দিষ্ট।

রায়দুর্লভ : আমার দাবিও তাই। তবে আর একটা কথা। চারদিককার অবস্থা দেখে যদি বুঝি যে, আপনাদের সাফল্যের কোনো আশা নেই, তা হলে কিন্তু আমার সহায়তা আপনারা আশা করবেন না?

মিরন : (ঈষৎ বিস্মিত) কী ব্যাপার? আপনাকে যেন কিছুটা আতঙ্কিত মনে হচ্ছে।

রায়দুর্লভ : আতঙ্কিত নই। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। চারিদিকে শুধু অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্র। এর ভেতরে কর্তব্য স্থির করাই দায় হয়ে উঠেছে।

                                                                                                         (পরিচারিকার প্রবেশ)

পরিচারিকা : মেহমান।

রায়দুর্লভ : আমি সরে পড়ি।

মিরন : বসেই যান না। মেহমানরা এসে পড়েছেন। কিছুক্ষণের ভেতরেই বৈঠক শুরু হয়ে যাবে।

রায়দুর্লভ : না আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। আমি পালাই। কিন্তু আমার সঙ্গে যে ওয়াদা তার যেন খেলাপ না হয়।  (প্রস্থান) 

(পরিচারিকাকে ইঙ্গিত করে মিরন কিছুটা প্রস্তুত হয়ে বসল। কামরায় ঢুকলেন রাজবল্লভ, জগৎশেঠ,

মিরজাফর। মিরন সমাদর করে তাদের বসালো।)

মিরন : একটু আগে রায়দুর্লভ এসেছিলেন। ব্যক্তিগত কারণে তিনি আলোচনায় থাকতে পারবেন না বললেন। কিন্তু তাঁর দাবির কথাটা আমার কাছে তিনি খোলাখুলিই জানিয়ে গেছেন।

জগৎশেঠ : তাঁকে প্রধান সেনাপতি পদ দিতে হবে এই তো?

রাজবল্লভ : সবাই উচ্চাভিলাষী। সবাই সুযোগ খুঁজছে। তা না হলে রায়দুর্লভ মাসে মাসে আমার কাছ থেকে যে বেতন পাচ্ছে তাতেই তার স্বর্গ হাতে পাবার কথা।

মিরজাফর : ও সব কথা থাক রাজা। সবাই একজোটে কাজ করতে হবে। সকলের দাবিই মানতে হবে। রায়দুর্লভ ক্ষুদ্র শক্তিধর। তার সাহায্যেই আমরা জিতব এমন কথা নয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে নবাবের সঙ্গে তার বিশ্বাসঘাতকতার গুরুত্ব আছে বৈ কি                                                                                                                                                                                               (পরিচারিকার প্রবেশ)

পরিচারিকা : জানানা সওয়ারি।

 (সবাই একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। মিরজাফর হঠাৎ পকেট থেকে কয়েক টুকরো কাগজ বের করে তাতে মন দিলেন। মিরন লজ্জিত। হঠাৎ আত্মসংবরণ করে ধমকে উঠল)

মিরন : ভাগো হিঁয়াসে, কমবখৎ।

                                                                                                                   (পরিচারিকার দ্রুত প্রস্থান)

রাজবল্লভ : (ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে) চট করে দেখে এসো। আত্মীয়ারাই কেউ হবেন হয়ত।

 (সুযোগটুকু পেয়ে মিরন তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল। অভাবিত পরিবেশ এড়াবার জন্যে জগৎশেঠ নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন)

জগৎশেঠ : আজকের আলোচনায় উমিচাঁদ অনুপস্থিত। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে তো আর কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব নয়।

মিরজাফর : (হঠাৎ যেন পরিবেশের খেই ধরতে পেয়েছেন) আরে বাপরে, একবারে কাল কেউটে। তার দাবিই তো সকলের আগে। তা না হলে দন্ড না পেরোতেই সমস্ত খবর পৌঁছে যাবে নবাবের দরবারে। মনে হয় কলকাতায় বসেই সে চুক্তিতে স্বাক্ষর দেবে। (দুজন মহিলাসহ উল্লসিত মিরন কামরায় ঢুকলো)

মিরন : এঁরাই জানানা সওয়ারি।

                                                  (রমনীর ছদ্মবেশ ত্যাগ করলেন ওয়াটস এবং ক্লাইভ মিরন বেরিয়ে গেল)

ওয়াটস : Sorry to disappoint you gentlemen ইনি রবার্ট ক্লাইভ।

মিরজাফর : (সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে) কর্নেল ক্লাইভ?

ক্লাইভ : Are you surprised? অবাক হলেন।

মিরজাফর : অবাক হবারই কথা। এ সময়ে এভাবে এখানে আসা খুবই বিপজ্জনক।

ক্লাইভ : বিপদ? কার বিপদ জাফর আলি খান? আপনার না আমার?

মিরজাফর : দুজনেরই। তবে আপনার কিছুটা বেশি।

ক্লাইভ : আমার কোনো বিপদ নেই। তা ছাড়া বিপদ ঘটাবে কে?

জগৎশেঠ : নবাবের গুপ্তচরের হাতে তো পড়োনি?

ক্লাইভ : নবাবকে আমার কোনো ভয় নেই। কারণ সে আমাদের কিছুই করতে পারবে না।

রাজবল্লভ : কেন পারবে না? গাল ফুলিয়ে বড় বড় কথা বললেই সব হয়ে গেল নাকি! তুমি এখানে একা এসেছো। তোমাকে বস্তাবন্দি হুলো বেড়ালের মতো পানাপুকুরে দুচারটে চুবুনি দিতে বাদশাহের ফরমান জোগাড় করতে হবে নাকি?

ক্লাইভ : I do not understand your Hulo business. But am sure Nabab can cuse no harm

to us.

জগৎশেঠ : ভগবানের দিব্যি কর্নেল সাহেব, তোমরা বড় বেহায়া। এই সেদিন কলকাতায় যা মার খেয়েছো এখনো তার ব্যথা ভোলার কথা নয়। এরি ভেতরে-

 ক্লাইভ : দেখো শেঠজি, এক আধবার অমন হয়েই থাকে। তাছাড়া রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে এখনো যুদ্ধ হয়নি। যখন হবে তখন তোমরাই তার ফলাফল দেখবে।

রাজবল্লভ : সেটা দেখবার আগেই গলাবাজি করছ কেন?

ক্লাইভ : এই জন্যে যে নবাবের কোনো ক্ষমতা নেই। যার প্রধান সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক, যার খাজাঞ্চি, দেওয়ান, আমির, ওমরাহ সবাই প্রতারক তার কোনো ক্ষমতা থাকতে পারে না। তবে হ্যাঁ আপনারা ইচ্ছে করলে আমাদের ক্ষতি করতে পারেন।

রাজবল্লভ : আমরা?

ক্লাইভ :  Why not? আপনারা সব পারেন। আজ নবাবকে ডোবাচ্ছেন, কাল আমাদের পথে বসাবেন না তা কি বিশ্বাস করা যায়? আমি বরং নবাবকে বিশ্বাস করতে পারি, কিন্তু-

মিরজাফর : এই সব কথার জন্যেই আমরা এখানে হাজির হয়েছি নাকি?

ক্লাইভ : Sorry, Mr. Jafar Ali Khan. হ্যাঁ একটা জরুরি কথা আগেই সেরে নেওয়া যাক। উমিচাঁদ এ যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক। আমাদের প্লানের কথা সে নবাবকে জানিয়ে দিয়েছে। কলকাতা attack এর সময়ে তার যা ক্ষতি হয়েছিল নবাব তা compensate করতে চেয়েছেন।  Scoundrel টা আবার এক নতুন offer নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে।

মিরজাফর : আমি শুনেছি সে আরও ত্রিশ লক্ষ টাকা চায়।

ক্লাইভ : এবং তাকে অত টাকা দেবার মতো পজিশান আমাদের নয়। থাকলেও আমরা তা দেব না। কেন দেব?

                    ? Why? Thirty lacs of rupees is no joke.

রাজবল্লভ : কিন্তু উমিচাঁদ যে রকম ধড়িবাজ তাতে সে হয়ত অন্যরকম কিছু ষড়যন্ত্র করতে পারে। আমাদের যাবতীয় গুপ্ত খবর তার জানা।

ক্লাইভ :  Don`t worry Raja। উমিচাঁদ অনেক বুদ্ধি রাখে। But Clive is no less আমি উমিচাঁদকে ঠকাবার ব্যবস্থা করেছি।

মিরজাফর : কী রকম?

ক্লাইভ : দুটো দলিল হবে। আসল দলিলে উমিচাঁদের কোনো reference থাকবে না। নকল দলিলে লেখা থাকবে যে, নবাব হেরে গেলে কোম্পানি উমিচাঁদকে ত্রিশ লক্ষ টাকা দেবে।

রাজবল্লভ : কিন্তু সে যদি কোনো রকমে এ কথা জানতে পারে?

ক্লাইভ : আপনারা না জানালে জানবে না। আর জানলে কারও বুঝতে বাকি থাকেবে না যে আপনারাই তা জানিয়েছেন।

জগৎশেঠ : আমাদের সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।

মিরজাফর : দলিল সই করবে কে?

ক্লাইভ : কমিটির সকলেই করেছেন। এখানে আপনি সই করবেন এবং রাজা রাজবল্লভ ও জগৎশেঠ থাকবেন উইটনেস। নকল দলিলটায় এ্যাডমিরাল ওয়াটসন সই করতে রাজি হননি।

মিরজাফর : উমিচাঁদ মানবে কেন তা হলে?

ক্লাইভ : সে ব্যবস্থা হয়েছে। ওয়াটসনের সই জাল করে দিয়েছে লুসিংটন।

জগৎশেঠ : তা হলে আর দেরি কেন? আমাদের আবার এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়।

ক্লাইভ : Of course দলিল দুটোই তৈরি আছে। শুধু সই হয়ে গেলেই কাজ মিটে যায়।

                                                                         (দলিলের কপি মিরজাফরের দিকে এগিয়ে দিল)

মিরজাফর : একটু পড়ে দেখব না?

ক্লাইভ : ড্রাফটতো আগেই পড়েছেন।

রাজবল্লভ : তা হলেও একবার পড়ে দেখা দরকার।

ক্লাইভ :If you want go ahead পড়ে দেখুন উমিচাঁদের মতো আপনাদেরও ঠকানো হয়েছে কি না।

মিরজাফর : (দলিলটা রাজবল্লভের দিকে এগিয়ে দিয়ে) নিন রাজা আপনিই পড়ুন।

রাজবল্লভ : (পড়তে পড়তে) যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতন হলে কোম্পানি পাবেন এক কোটি টাকা, কলকাতার বাসিন্দারা ক্ষতিপূরণ বাবদ পাবেন সত্তর লক্ষ টাকা, ক্লাইভ সাহেব পাবেন দশ লক্ষ টাকা, এ্যাডমিরাল ওয়াটসন পাবেমিরজাফর : ওগুলো দেখে আর লাভ কী?

রাজবল্লভ : এখন আর কিছু লাভ নেই, কিন্তু ভাবছি নবাবের তহবিল দুবার করে লুট করলেও তিন কোটি টাকা পাওয়া যাবে কিনা।

মিরজাফর : বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসুন দস্তখত দিয়ে কাজ শেষ করে ফেলি।

রাজবল্লভ : এ সন্ধি অনুসারে সিপাহসালার শুধু মসনদে বসবেন। কিন্তু রাজ্য চালাবেন কোম্পানি।

ক্লাইভ : (বিরক্ত) You are thinking like a fool

আমরা কেন রাজ্য চালাবো। আমরা শুধু ব্যবসা বাণিজ্য করবার  Privilege secure করে নিচ্ছি। তা আমাদের করতেই হবে।

জগৎশেঠ : আপনাদের স্বার্থ রক্ষা করুন। কিন্তু দেশের শাসন ক্ষমতায় আপনারা হাত দেবেন এ তো ভালো কথা নয়।

ক্লাইভ : (রীতিমত ক্রুদ্ধ)  Then what you are going to do about it? দলিল দুটো তা হলে ফিরিয়ে নিয়ে

যাই। আপনাদের শর্তাদি জানিয়ে দেবেন। সেইভাবে আবার একটা খসড়া তৈরি করা যাবে।

মিরজাফর : না না সেকি কথা? এমনিতেই বাজারে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। কোন্দিন সিরাজউদ্দৌলা সবাইকে গারদে পুরে দেবে তার ঠিক নেই। দিন আমি দলিল সই করে দিই। শুভকাজে অযথা বিলম্ব করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

 (রাজবল্লভের হাত থেকে দলিল নিয়ে সই করতে বসল। কিন্তু একটু ইতস্তত করে-)

মিরজাফর : বুকের ভেতের হঠাৎ যেন কেঁপে উঠল। বাইরে কোথাও মরাকান্না শুনতে পাচ্ছেন শেঠজি?

জগৎশেঠ : না না, মরাকান্না আবার কোথায়?

মিরজাফর : আমি যেন শুনলাম।

ক্লাইভ : (উচ্চহাসি) বিদ্রোহী সেনাপতি অথচ Women থেকেও coward|

রাজবল্লভ : নানা প্রকারের দুশ্চিন্তায় আপনার শরীর মন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ও কিছু নয়।

মিরজাফর : তাই হয়ত।

                                                                               (কলম নিয়ে স্বাক্ষর দিতে গিয়ে আবার ইতস্তত করল)

মিরজাফর : কিন্তু রাজবল্লভ যেমন বল্লেন, সবাই মিলে সত্যিই আমরা বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছি না তো?

ক্লাইভ : Oh, what nonsense আমি জানতাম coward দের ওপর কোনো কাজের জন্যেই ভরসা করা যায় না। তাই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে দলিল সই করাতে নিজেই এসেছি। একা ওয়াটসকে পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারিনি। এখন দেখছি আমার অনুমান অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। (মিরজাফরকে) আরে বাংলা আপনাদেরই থাকবে। রাজা হয়ে আমরা কী করব। আমরা চাই টাকা। আপনাদের কোনো ভয় নেই |you are sacrificing the Nabab and not the country. . দেশের জন্যে দেশের নবাবকে আপনারা সরিয়ে দিচ্ছেন। কারণ, সে অত্যাচারী। সে থাকলে দেশের কল্যাণ হবে না।

মিরজাফর : আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা নবাবকে সরিয়ে দিচ্ছি। সে আমাদের সম্মান দেয় না।

 (দলিলে সই করল। নেপথ্যে করুণ সংগীত চলতে থাকবে। জগৎশেঠ এবং রাজবল্লভও সই করল)

ক্লাইভ :That's all right (দলিল ভাঁজ করতে করতে) আমরা এমন কিছু করলাম যা ইতিহাস হবে। | we have done a great thing- a great thing (ক্লাইভ এবং ওয়াটস আবার রমণীর ছদ্মবেশ নিল, তারপর সবাই বেরিয়ে গেলো। অন্যদিক দিয়ে মিরনের প্রবেশ।)

মিরন : হা হা হা। আর দেরি নেই। আগামীকাল যুদ্ধ। জানিস আগামী পরশু কী হবে? আগামী পরশু আমি শাহজাদা মিরন। শাহজাদা হা হা হা। তারপর একদিন বাংলার নবাব।

                                                                                                                 (দ্রুত জনৈক রক্ষীর প্রবেশ)

রক্ষী : হুজুর, সেনাপতি মোহনলাল।

মিরন : (আতঙ্কিত) মোহনলাল। (ফরাসে বসে পড়ল। মোহনলালের প্রবেশ)

মোহনলাল : শুনলাম আজ এখানে ভারী জলসা হচ্ছে। বহু গণ্যমান্য লোক উপস্থিত আছেন। তাই খোঁজ নিতে এলাম।

মিরন : সেনাপতি মোহনলাল, আপনার দুঃসাহসের সীমা নেই। আমার প্রাসাদে কার অনুমতিতে আপনি প্রবেশ করেছেন?

মোহনলাল : প্রয়োজন মতো যে কোনো জায়গায় যাবার অনুমতি আমার আছে। সত্য বলুন এখানে গুপ্ত ষড়যন্ত্র হচ্ছিল কি না?

মিরন : মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন সেনাপতি। জানেন এর ফল কী ভয়ানক হতে পারে? নবাবের সঙ্গে আব্বার সমস্ত গোলমাল সেদিন প্রকাশ্যে মিটমাট হয়ে গেল। নবাব তাকে বিশ্বাস করে সৈন্য পরিচালনার ভার দিয়েছেন। আর আপনি এসেছেন আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপবাদ নিয়ে। আমি এখুনি আব্বাকে নিয়ে নবাবের প্রাসাদে যাবে। (উঠে দাঁড়ালো)  এই অপমানের বিচার হওয়া দরকার।

মোহনলাল : প্রতারণার চেষ্টা করবেন না। (তরবারি কোষমুক্ত করল) আমার গুপ্তচর ভুল সংবাদ দেয় না। সত্য বলুন, কী হচ্ছিল এখানে? কে কে ছিল মন্ত্রণা সভায়?

মিরন : মন্ত্রণা সভা হচ্ছিল কিনা, এবং হলে কোথায় হচ্ছিল আমি তার কিছুই জানিনে। এসব বাজে জিনিসে সময় কাটানো আমার স্বভাব নয়।

                                                                                    (পরিচারককে ডেকে মিরন কিছু ইঙ্গিত করল)

 যখন নাছোড় হয়েছেন তখন বে-আদবি না করে আর উপায় কী?

                                                                                                     (নর্তকীর প্রবেশ)

 এখানে কী হচ্ছিল আশা করি সেনাপতি বুঝতে পেরেছেন? (একটি মালা নিয়ে নাচের ভঙ্গিতে দুলতে দুলতে নর্তকি মোহনলালের দিকে এগিয়ে গেলো। মোহনলাল তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে মালাটি গ্রহণ করে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে তরবারির দ্বিতীয় আঘাতে শূন্যেই তা দ্বিখন্ডিত করে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল)।

মিরন : মুর্তিমান বেরসিক হা হা হা-- 

                                                                          (হাত তালি দিতেই পরিচারিকার প্রবেশ) 

 

শব্দের অর্থ ও টীকা

অনাচার--   বিশৃঙ্খলা, ন্যায়-নীতিহীনতা, যথেচ্ছাচার। 

অবনত--নিচু। 

অগ্নিগিরি-- আগুনের পর্বত। 

অশ্বারোহী-- ঘোড়ার পিঠে চরে যুদ্ধ করে যে সৈনিক। 

আলবৎ--  অবশ্য, নিশ্চয়। 

আজ্ঞাবহ-- যে আজ্ঞা বা আদেশ পালন করে। 

ইজারাদার-- কর বা খাজনা আছে এমন জমির ইজারা নেয় যে। 

উৎকণ্ঠিত-- চিন্তিত। 

কন্দকাটা--গলা কাটা। 

কর্মপন্থা-- কাজ করার প্রক্রিয়া ও পথ। 

কৈফিয়ত-- জবাবদিহি, নিজ দোষের কারণ প্রদর্শন। 

কুর্নিশ-- সালাম, অভিবাদন। 

খেলাপ-- অমান্য। 

খোলাসা করা-- পরিষ্কার করা, সব কিছু খুলে বলা। 

গর্দান-- স্কন্ধ, ঘাড়, গলা। 

গুপ্তচর-- গোয়েন্দা, গোপনে যে ব্যক্তি সংবাদ সংগ্রহ করে। 

জালিম--অত্যাচারী, শোষক। 

ঠিয়ালদের-- কোম্পানীর প্রতিনিধি, যারা কুঠিতে বাস করেন। 

ডুকরে--ফুঁপিয়ে কাঁদা।

তহবিল-- সিংহাসন। 

তারিফ-- প্রশংসা। 

দেউড়ী-- বাড়ির প্রধান প্রবেশদ্বার, সদর দরজা। 

নকীব-- ঘোষক।

নতজানু-- আত্মসমর্পণ। 

পোয়াতি--সন্তানসম্ভবা। 

প্রশ্রয়-- আশকারা, লাই, আদর। 

বরখাস্ত--অপসারণ। 

কয়েদখানা-- বন্দিশালা, কারাগার। 

বিনাশ-- ধ্বংস। 

বিদ্বেষ-- হিংসা। 

বেনিয়ার জাত-- ব্যবসায়ী জাত, ব্যবসা করাই যাদের জাতিগত পরিচয়। 

সিপাহসালার-- সেনাপতি, সৈন্যাধক্ষ। 

সম্প্রীতি-- সুসম্পর্ক, ভালো সম্পর্ক। 


সারসংক্ষেপ

মুর্শিদাবাদে নবাবের শাহী দরবারে সভাসদদের নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বসে আছেন। তিনি অত্যাচারী এবং ষড়যন্ত্রীদের শাস্তি দিতে চান। সভাসদ এবং কোম্পানির প্রতিনিধিকে সভায় ডেকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য সকলেই নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। নবাব সকলকে সবকিছু ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করার কথা বলেন। 

কোরান শরিফ ছুঁয়ে প্রধান সেনাপতি মিরজাফর বললেন--‘আমি আল্লাহর পাক কালাম ছুঁয়ে ওয়াদা করছি, আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব।’ রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ তামা, তুলসী, গঙ্গাজল ছুঁয়ে একই শপথ নিলেন।এই শপথের পরেই মিরজাফরের বাড়িতে এরাই গোপন মন্ত্রণাসভায় বসেছে। সকলের চিন্তা একই- এই মুহূর্তেই সিরাজকে গদিচ্যুত করতে হবে। নবাবকে গদিচ্যুত করার জন্যে মিরজাফর ইংরেজদের সহযোগিতাও প্রার্থনা করলেন। মিরনের বাসগৃহে আয়োজন করা হয়েছে নবাব-বিরোধী এক গোপন বৈঠকের। 

উচ্চাভিলাষী রায়দুর্লভের একান্ত অভিলাষ- নবাবের পতনের পর তিনি হবেন নতুন নবাবের প্রধান সেনাপতি। মিরন এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন তাকে। একে একে মিরনের কামরায় প্রবেশ করেন রাজবলল্লভ, জগৎশেঠ ও মিরজাফর। নবাব-বিরোধী এই ষড়যন্ত্রবৈঠকে ক্লাইভ প্রথমেই উত্থাপন করেন চতুর বিশ্বাসঘাতক উমিচাঁদের প্রসঙ্গ। আসন্ন যুদ্ধে সহায়তার বিনিময়ে তার দাবি নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা। ধূর্ত ক্লাইভ এ দাবি পূরণে অসম্মত। তিনি নতুন ফন্দি এঁটেছেন উমিচাঁদকে ঠকাবার।

ক্লাইভের প্রস্তুতকৃত সমঝোতা দলিল অনুসারে নবাবের পতনের পর সিপাহসালার শুধু মসনদে বসবেন মাত্র, রাজ্য পরিচালনা করবে কোম্পানি। দস্তখত করার মুহূর্তে তার বুকে কেঁপে ওঠে, শুনতে পান মরাকান্নার ধ্বনি। মিরজাফরের মনে হয় তারা সবাই মিলে বাংলাকে বিক্রয় করে দিচ্ছেন না তো? পরিশেষে স্বাক্ষর দান করেন মিরজাফর। ক্লাইভ সন্তোষ চেপে রাখতে পারেন না; ‘আমরা এমন কিছু করলাম যা ইতিহাস হবে’, -বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

বৈঠক সমাপ্তির পর মিরনের উল্লাসমুহূর্তে আকস্মিকভাবেই তার আবাসগৃহে প্রবেশ করেন নবাব সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলাল। জেরার মুখে মিরন অস্বীকার করে বৈঠকের প্রসঙ্গ। অভিনয় পটু মিরন নৃত্যগীতের উপকরণ দেখিয়ে বিভ্রান্ত করতে চায় মোহনলালকে। শেষে প্রলুব্ধ করার জন্য এক পরিচারিকাকে সামনে ঠেলে দেয় মিরন। কর্তব্যপরায়ণ মোহনলাল পরিচারিকাটিকে উপেক্ষা করে দ্রুত বেরিয়ে যান মিরনের গৃহ থেকে। 


বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

৯. সিরাজের দরবারে কোম্পানির প্রতিনিধি কে?

ক. ওয়াটস্                                       খ. হলওয়েল

গ. ক্লাইভ                                         ঘ. ক্লেটন

১০. মোহনলাল মূর্তিমান বেরসিক কেন?

ক. নাচ-গানে আসক্তি নেই                         খ. প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে যোগ দেননি

গ. সিরাজের পক্ষাবলম্বন করেছেন                 ঘ. দলিলে সই করেননি

নিচের উদ্দীপকটি পড়–ন এবং ১১ ও ১২ নং প্রশ্নের উত্তর দিন :

মোহাম্মদ আলি কটক শহরের একজন নামকরা এ্যাডভোকেট। অর্থ তার নিকট মধুর চেয়ে মিষ্ট। কোর্টে মোকদ্দমা শুরু করার পূর্বেই তিনি তার ফিস পুরোটা আদায় করে নেন। আত্মীয়-স্বজনরাও তার এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েন না। টাকা তার নিকট ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়।

১১. উদ্দীপকের সঙ্গে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে কার সাদৃশ্য রয়েছে?

ক. উমিচাঁদ                            খ. মোহনলাল

গ. মির জাফর                         ঘ. রবার্ট ক্লাইভ

১২. উদ্দীপকের সঙ্গে নাটকের এরূপ সাদৃশ্য যে বিষয়ে-

i.অমাত্যদের অর্থলিপ্সায় 

ii.মিরজাফরের কুটিলতায়   

iii.সিরাজের বর্বরতায়

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i                                        খ.ii 

গ.iii                                       ঘ.ii ও iii 

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর

০৯. ক ১০. ক ১১. ক ১২. ক

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনেট আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url