এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ-২

 পাঠ-২

সিরাজউদ্দৌলা

  সিকান্দার আবু জাফর


পাঠভিত্তিক উদ্দেশ্য

এ পাঠটি পড়ে তুমি-

  • ‘সিরাজউদ্দৌলা নাটকের প্রাসঙ্গিক পরিচয় লিখতে পারবে।
  • সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কথা লিখতে পারবে।
  • সিরাজের পতনের জন্য ইংরেজদের সঙ্গে এ-দেশের যে সব ব্যক্তি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, তাদের ভূমিকা বর্ণনা করতে পারবে।
  • সিরাজের চরিত্রের কতিপয় বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারবে।
  • ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ঐতিহাসিক পটভ‚মিকা বর্ণনা করতে পারবে।

মূলপাঠ

প্রথম অঙ্ক

যবনিকা উত্তোলনের অব্যবহিত পূর্বে আবহ সংগীতের পটভূমিতে নেপথ্যে ঘোষণা :

ঘোষণা : এক স্বাধীন বাংলা থেকে আর এক স্বাধীন বাংলায় আসতে বহু দুর্যোগের পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি; বহু লাঞ্ছনা বহু পীড়নের গ্লানি আমার সহ্য করেছি। দুই স্বাধীন বাংলার ভেতরে আমাদের সম্পর্ক তাই অত্যন্ত গভীর। আজ এই নতুন দিনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিস্মৃত অতীতের পানে দৃষ্টি ফেরালে বাংলার শেষ সূর্যালোকিত দিনের সীমান্ত রেখায় আমরা দেখতে পাই নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে।

নবাব সিরাজের দুর্বহ জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনি আমরা স্মরণ করি গভীর বেদনায়, গভীর সহানুভূতিতে। সে কাহিনি আমাদের ঐতিহ্য। আজ তাই অতীতের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্য আমরা বিস্মৃতির যবনিকা উত্তোলন করছি।

আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র নাটক :সিরাজউদ্দৌলা 

এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ ১

এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: বাংলা ১ম পত্র নাটক সিরাজউদ্দৌলা সিকান্দার আবু জাফর(Admission Test)

১৭৫৬ সাল : ১৯ জুন।

প্রথম দৃশ্য

সময় : ১৭৫৬ সাল, ১৯ জুন। স্থান : ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ।

[চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে --ক্যাপ্টেন ক্লেটন, ওয়ালি খান, জর্জ হলওয়ে, উমিচাঁদ, মিরমর্দান, মানিক চাঁদ, সিরাজ, রায়দুর্লভ, ওয়াটস।]

(নবাব সৈন্য দুর্গ আক্রমণ করেছে। দুর্গের ভেতরে ইংরেজদের অবস্থা শোচনীয়। তবু যুদ্ধ না করে উপায় নেই। তাই ক্যাপ্টেন ক্লেটন দুর্গ প্রাচীরের এক অংশ থেকে মুষ্টিমেয় গোলন্দাজ নিয়ে কামান চালাচ্ছেন। ইংরেজ সৈন্যের মনে কোনো উৎসাহ নেই, তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।)

ক্লেটন : প্রাণপণে যুদ্ধ করো সাহসী ব্রিটিশ সৈনিক। যুদ্ধে জয়লাভ অথবা মৃত্যুবরণ, এই আমাদের প্রতিজ্ঞা  (Victory or death- Victory or death. ) গোলাগুলির শব্দ প্রবল হয়ে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্লেটন একজন বাঙালি গোলন্দাজের দিকে এগিয়ে গেলেন)। 

ক্লেটন : তোমরা, তোমরাও প্রাণপণে যুদ্ধ করো বাঙালি বীর। বিপদ আসন্ন দেখে কাপুরুষের মতো হাল ছেড়ে দিও না। যুদ্ধ করো, প্রাণপণে যুদ্ধ করো।

                                                                                                             (একজন প্রহরীর প্রবেশ)

ওয়ালি খান : যুদ্ধ বন্ধ করবার আদেশ দিন ক্যাপ্টেন ক্লেটন। নবাব সৈন্য দুর্গের কাছাকাছি এসে পড়েছে।

ক্লেটন : না, না।

ওয়ালি : এখুনি যুদ্ধ বন্ধ করুন। নবাব সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে দুর্গের একটি প্রাণীকেও তারা রেহাই দেবে না।

ক্লেটন : চুপ বেঈমান। কাপুরুষ বাঙালির কথায় যুদ্ধ বন্ধ হবে না।

ওয়ালি : ও সব কথা বলবেন না সাহেব। ইংরেজের হয়ে যুদ্ধ করছি কোম্পানির টাকার জন্যে। তা বলে বাঙালি কাপুরুষ নয়। যুদ্ধ বন্ধ না করলে নবাব সৈন্য এখুনি তার প্রমাণ দেবে।

ক্লেটন :What? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা?  (ওয়ালি খানকে চড় মারার জন্যে এগিয়ে গেল। অপর একজন রক্ষীর দ্রুত প্রবেশ)

জর্জ : ক্যাপ্টেন ক্লেটন, অধিনায়ক এনসাইন পিকার্ডের পতন হয়েছে। পেরিন্স পয়েন্টের সমস্ত ছাউনি ছারখার করে দিয়ে ভারী ভারী কামান নিয়ে নবাব সৈন্য দুর্গের দিকে এগিয়ে আসছে।

ক্লেটন : কী করে তারা এখানে আসবার রাস্তা খুঁজে পেলো?

জর্জ : উমিচাঁদের গুপ্তচর নবাব ছাউনিতে খবর পাঠিয়েছে। নবাবের পদাতিক বাহিনী দমদমের সরু রাস্তা দিয়ে চলে এসেছে, আর গোলন্দাজ বাহিনী শিয়ালদহের মারাঠা খাল পেরিয়ে বন্যাস্রোতের মতো ছুটে আসছে।

ক্লেটন : বাধা দেবার কেউ নেই। (ক্ষিপ্তস্বরে) ক্যাপ্টেন মিনচিন দমদমের রাস্তাটা উড়িয়ে দিতে পারেননি?

জর্জ : ক্যাপ্টেন মিন্চিন, কাউন্সিলার ফ্রাঙ্কল্যান্ড আর ম্যানিংহাম নৌকোয় করে দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছেন।

ক্লেটন : কাপুরুষ, বেঈমান। জ্বলন্ত আগুনের মুখে বন্ধুদের ফেলে পালিয়ে যায়। চালাও, গুলি চালাও। নবাব সৈন্যদের দেখিয়ে দাও যে, বিপদের মুখে ইংল্যান্ডের বীর সন্তান কতখানি দুর্জয় হয়ে ওঠে।

                                                                                    (জন হলওয়েলের প্রবেশ এবং জর্জের প্রস্থান)

হলওয়েল : এখন গুলি চালিয়ে বিশেষ ফল হবে কি, ক্যাপ্টেন ক্লেটন?

ক্লেটন : যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেওয়া ছাড়া আর উপায় কী সার্জন হলওয়েল?

হলওয়েল : আমার মনে হয় গভর্নর রজার ড্রেকের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করাই এখন যুক্তিসঙ্গত।

ক্লেটন : তাকে কি নবাবের অত্যাচারের হাত থেকে আমরা রেহাই পাবো ভেবেছেন?

হলওয়েল : তবু কিছুটা আশা থাকবে। কিন্তু যুদ্ধ করে টিকে থাকবার কোনো আশা নেই। গোলাগুলি যা আছে তা দিয়ে আজ সন্ধ্যে পর্যন্তও যুদ্ধ করা যাবে না। ডাচদের কাছে, ফরাসিদের কাছে, সবার কাছে আমরা সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু সৈন্য তো দূরের কথা এক ছটাক বারুদ পাঠিয়েও কেউ আমাদের সাহায্য করল না।

                                                                                  (বাইরে গোলার আওয়াজ প্রবলতর হয়ে উঠল)

ক্লেটন : তা হলে আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমি গভর্ণর ড্রেকের সঙ্গে একবার আলাপ করে আসি।

(ক্লেটনের প্রস্থান। বাইরে থেকে যথারীতি গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। হলওয়েল চিন্তিতভাবে এদিকওদিক পায়চারি করছে।)

হলওয়েল : (পায়চারি থামিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে) এই, কে আছ?

                                                                                         (রক্ষীর প্রবেশ)

ওমর খৈয়াম (১৯৬৬), সিংয়ের নাটক (১৯৭১)। 

আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র নাটক :সিরাজউদ্দৌলা 

এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: বাংলা ১ম পত্র নাটক সিরাজউদ্দৌলা সিকান্দার আবু জাফর(Admission Test)

জর্জ : Yes sir

হলওয়েল : উমিচাঁদকে বন্দি করে কোথায় রাখা হয়েছে?

জর্জ : পাশেই একটা ঘরে।

হলওয়েল : তাকে এখানে নিয়ে এসো।

জর্জ :Right sir

 (জর্জ দ্রুত বেরিয়ে চলে যায় এবং প্রায় পর মুহূর্তে উমিচাঁদকে নিয়ে প্রবেশ করে।)

উমিচাঁদ : (প্রবেশ করতে করতে) সুপ্রভাত সার্জন হলওয়েল।

হলওয়েল : সুপ্রভাত। তাই না উমিচাঁদ? (গোলাগুলির আওয়াজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হলওয়েল বিস্মিতভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন) নবাব সৈন্যের গোলাগুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন বলুন তো?

উমিচাঁদ : (কান পেতে শুনল) বোধ হয় দুপুরের আহারের জন্যে সাময়িক বিরতি দেওয়া হয়েছে।

হলওয়েল : এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে উমিচাঁদ। আপনি নবাবের সেন্যধ্যক্ষ রাজা মানিকচাঁদের কাছেএকখানা পত্র লিখে পাঠান। তাঁকে অনুরোধ করুন নবাব সৈন্য যেন আর যুদ্ধ না করে।

উমিচাঁদ : বন্দির কাছে এ প্রার্থনা কেন সার্জন হলওয়েল? (কঠিন স্বরে) আমি গভর্নর ড্রেকের ধ্বংস দেখতে চাই।

                                                                                                             (জর্জের প্রবেশ)

জর্জ : সার্জন হলওয়েল, গভর্নর রজার ড্রেক আর ক্যাপ্টেন ক্লেটন নৌকা করে পালিয়ে গেছেন।

হলওয়েল : দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছেন।

জর্জ : গভর্নরকে পালাতে দেখে একজন রক্ষী তাঁর দিকে গুলি ছুঁড়েছিল কিন্তু তিনি আহত হননি।

উমিচাঁদ : দুর্ভাগ্য, পরম দুর্ভাগ্য।

হলওয়েল : যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেবেন বলে আধঘণ্টা আগেও প্রতিজ্ঞা করছিলেন ক্যাপ্টেন ক্লেটন। শেষে তিনিও পালিয়ে গেলেন।

উমিচাঁদ : বৃটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন এ বড় লজ্জার কথা।

হলওয়েল : উমিচাঁদ, এখন উপায়?

উমিচাঁদ : আবার কী? ক্যাপ্টেন কর্নেলরা সব পালিয়ে গেছেন, এখন ফাঁকা ময়দানে গাইস হাসপাতালের হাতুড়ে সার্জন জন জেফানিয়া হলওয়েল সর্বাধিনায়ক। আপনিই এখন কম্যান্ডার ইন-চিফ।

                                                                                             (আবার প্রচন্ড গোলার আওয়াজ ভেসে এল)

হলওয়েল : (হতাশার স্বরে) উমিচাঁদ।

উমিচাঁদ : আচ্ছা, আমি রাজা মানিকচাঁদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছি। আপনি দুর্গ প্রাকারে সাদা নিশান উড়িয়ে দিন।

                              (উমিচাঁদের প্রস্থান। হঠাৎ বাইরে গোলমালের শব্দ শোনা গেল। বেগে জর্জের প্রবেশ।)

জর্জ : সর্বনাশ হয়েছে। একদল ডাচ সৈন্য গঙ্গার দিক্কার ফটক ভেঙ্গে পালিয়ে গেছে। সেই পথ দিয়ে নবাবের সশস্ত্র পদাতিক বাহিনী হুড় হুড় করে কেল্লার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

হলওয়েল : সাদা নিশান ওড়াও। দুর্গ তোরণে সাদা নিশান উড়িয়ে দাও।

(জর্জ ছুটে বেরিয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নবাব সৈন্যের অধিনায়ক রাজা মানিকচাঁদ ও মিরমর্দানের প্রবেশ।)

মিরমর্দান : এই যে দুশমনরা এখান থেকেই গুলি চালাচ্ছে।

হলওয়েল : আমরা সন্ধির সাদা নিশান উড়িয়ে দিয়েছি। যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে।

মিরমর্দান : সন্ধি না আত্মসমর্পণ?

মানিকচাঁদ : সবাই অস্ত্র ত্যাগ করো।

মিরমর্দান : মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও।

মানিকচাঁদ : তুমি হলওয়েল, তুমিও মাথার ওপর দু’হাত তুলে দাঁড়াও। কেউ একচুল নড়লে প্রাণ যাবে।

 (দ্রুতগতিতে নবাব সিরাজের প্রবেশ। পেছনে সসৈন্য সেনাপতি রায়দুর্লভ। বন্দিরা কুর্ণিশ করে এক পাশে সরে দাঁড়াল। সিরাজ চারদিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে হলওয়েলের দিকে এগিয়ে গেলেন।)

সিরাজ : কোম্পানির ঘুষখোর ডাক্তার রাতারাতি সেনাধ্যক্ষ হয়ে বসেছেন। তোমার কৃতকার্যের উপযুক্ত প্রতিফল নেবার জন্যে তৈরি হও হলওয়েল।

হলওয়েল : আশা করি নবাব আমাদের ওপরে অন্যায় জুলুম করবেন না।

সিরাজ : জুলুম? এ পর্যন্ত তোমরা যে আচরণ করে এসেছো তাতে তোমাদের ওপরে সত্যিকার জুলুম করতে পারলে আমি খুশি হতুম। গভর্নর ড্রেক কোথায়?

হলওয়েল : তিনি কলকাতার বাইরে গেছেন। 

সিরাজ : কলকাতার বাইরে গেছেন, না প্রাণ নিয়ে পালিয়েছেন? আমি সব খবর রাখি হলওয়েল। নবাব সৈন্য কলকাতা আক্রমণ করবার সঙ্গে সঙ্গে রজার ড্রেক প্রাণভয়ে কুকুরের মতো ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কৈফিয়ৎ তবু কাউকে দিতেই হবে। বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার স্পর্ধা ইংরেজ পেলো কোথা থেকে আমি তার কৈফিয়ৎ চাই।

হলওয়েল : আমরা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইনি। শুধু আত্মরক্ষার জন্যে-

সিরাজ : শুধু আত্মরক্ষার জন্যেই কাশিমবাজার কুঠিতে তোমরা গোপনে অস্ত্র আমদানি করছিলে তাই না? খবর পেয়ে আমার হুকুমে কাশিমবাজার কুঠি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দি করা হয়েছে ওয়াটস আর কলেটকে। রায়দুর্লভ।

রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা।

সিরাজ : বন্দি ওয়াটসকে এখানে হাজির করুন।

                                                                                             (ওয়াটসসহ রায়দুর্লভের প্রবেশ)

 ওয়াটস!

ওয়াটস : Your Excellency

সিরাজ : আমি জানতে চাই তোমাদের অশিষ্ট আচরণের জবাবদিহি কে করবে? কাশিমবাজারে তোমরা গোলাগুলি আমদানি করছ, কলকাতার আশে পাশে গ্রামের পর গ্রাম তোমরা নিজেদের দখলে আনছ, দুর্গ সংস্কার করে তোমরা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছ, আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণবল্লভকে তোমরা আশ্রয় দিয়েছ, বাংলার মসনদে বসবার পর আমাকে তোমরা নজরানা পর্যন্ত পাঠাওনি। তোমরা কি ভেবেছ এই সব অনাচার আমি সহ্য করব?

ওয়াটস : আমরা আপনার অভিযোগের কথা কাউন্সিলের কাছে পেশ করব।

সিরাজ : তোমাদের ধৃষ্ঠতার জবাবদিহি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে তোমাদের বাণিজ্য করবার অধিকার আমি প্রত্যাহার করছি।

ওয়াটস : কিন্তু বাংলাদেশে বাণিজ্য করবার অনুমতি দিল্লির বাদশাহ আমাদের দিয়েছেন।

সিরাজ : বাদশাকে তোমরা ঘুষের টাকায় বশীভ‚ত করেছো। তিনি তোমাদের অনাচার দেখতে আসেন না। হলওয়েল : Your Excellency. নবাব আলিবর্দি আমাদের বাণিজ্য করবার অনুমতি দিয়েছেন।

সিরাজ : আর আমাদের তিনি যে অনুমতি করে গেছেন তা তোমাদের অজানা থাকবার কথা নয়। সে খবর এ্যাড্মিরাল ওয়াটসন, কিলপ্যাট্টিক, ক্লাইভ সকলেরই জানা আছে। মাদ্রাজে বসে ক্লাইভ লন্ডনের Secret Committe-র সঙ্গে যে পত্রালাপ করে তা আমার জানা নেই ভেবেছো? আমি সব জানি। তবু তোমাদের অবাধ বাণিজ্যে এ পর্যন্ত কোনো বিঘ্ন ঘটাইনি। কিন্তু সদ্ব্যবহার তো দূরের কথা তোমাদের জন্যে করুণা প্রকাশ করাও অন্যায়।

ওয়াটস : Your Excellency, আমাদের সন্বন্ধে ভুল খবর শুনেছেন। আমরা এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছি। We have come to earn money and not to get into politicos.. রাজনীতি আমরা কেন করব?

সিরাজ : তোমরা বাণিজ্য করো? তোমরা করো লুট। আর তাতে বাধা দিতে গেলেই তোমরা শাসন ব্যবস্থায় ওলটপালট আনতে চাও। কর্ণাটকে, দাক্ষিণাত্যে তোমরা কী করেছো? শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করে অবাধ লুঠতরাজের পথ পরিষ্কার করে নিয়েছো। বাংলাতেও তোমরা সেই ব্যবস্থাই করতে চাও। তা না হলে আমার নিষেধ সত্তে¡ও কলকাতার দুর্গ-সংস্কার তোমরা বন্ধ করনি। কেন?

হলওয়েল : ফরাসি ডাকাতদের হাত থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে চাই।

সিরাজ : ফরাসিরা ডাকাত আর ইংরেজরা অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি কেমন?

ওয়াটস : আমরা অশান্তি চাই না Your Excellecy।

সিরাজ : চাও কি না চাও সে বিচার পরে হবে। রায়দুর্লভ।

রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা। 

সিরাজ : গভর্নর ড্রেকের বাড়িটা কামানের গোলায় উড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিন। গোটা ফিরিঙ্গি পাড়ায় আগুন ধরিয়ে ঘোষণা করে দিন সমস্ত ইংরেজ যেন অবিলম্বে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। আশে-পাশের গ্রামবাসীদের জানিয়ে দিন তারা যেন কোনো ইংরেজের কাছে কোনো প্রকারের সওদা না বেঁচে। এই নিষেধ কেউ অগ্রাহ্য করলে তাকে গুরুতর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

রায়দুর্লভ : হুকুম জাঁহাপনা।

সিরাজ : আজ থেকে কলকাতার নাম হলো আলিনগর। রাজা মানিকচাঁদ, আপনাকে আলিনগরের দেওয়ান নিযুক্ত করলাম।

মানিকচাঁদ : জাঁহাপনার অনুগ্রহ।

সিরাজ : আপনি অবিলম্বে কোম্পানির যাবতীয় সম্পত্তি আর প্রত্যেকটি ইংরেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নবাব তহবিলে বাজেয়াপ্ত করুন। কলকাতা অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করবে কোম্পানির প্রতিনিধি আর কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এখানকার প্রত্যেকটি ইংরেজ।

মানিকচাঁদ : হুকুম জাঁহাপনা।

সিরাজ : নাসারার দুর্গ এই ফোর্ট উইলিয়ামের ভেতরে একটি মসজিদ তৈরি হবে। আয়োজন করুন সেনাপতি মিরমর্দান।

                                                                            ( সেনাপতি নত হয়ে আদেশ গ্রহণের ভঙ্গী করলেন)

সিরাজ : (উমিচাঁদের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে) আপনাকে মুক্তি দেওয়া হলো, উমিচাঁদ।

                                                                                                                     (উমিচাঁদ কৃতজ্ঞতায় নতশির)

 আর (মিরমর্দানকে) হ্যাঁ, রাজা রাজবল্লভের সঙ্গে আমার একটা মিটমাট হয়ে গেছে। কাজেই কৃষ্ণবল্লভকেও মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করুন।

মিরমর্দান : হুকুম, জাঁহাপনা।

সিরাজ : হলওয়েল।

হলওয়েল : Your Excellency.

সিরাজ : তোমার সৈন্যদের মুক্তি দিচ্ছি, কিন্তু তুমি আমার বন্দি। (রায়দুর্লভকে) কয়েদি হলওয়েল, ওয়াটস আর কলেটকে আমার সঙ্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে আমি তাদের বিচার করব।

রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা।

 (সিরাজ বেরিয়ে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাই মাথা নুইয়ে তাঁকে কুর্নিশ করল।)

                                                                                                                                                                                                                                                                      [দৃশ্যান্তর] 

প্রথম অংক: দ্বিতীয় দৃশ্য 

সময় : ১৭৫৬ সাল, ৩ জুলাই। স্থান : কলকাতার ভাগীরথী নদীতে ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজ

চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- ড্রেক, হ্যারি, মার্টিন, কিলপ্যাট্রিক, ইংরেজ মহিলা, সৈনিক, হলওয়েল, ওয়াটস, আর্দালি)

(কলকাতা থেকে তাড়া খেয়ে ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক এবং তাদের দলবল এই জাহাজে আশ্রয় নিয়েছে। সকলের চরম দুরবস্থা। আহার্য দ্রব্য প্রায়ই পাওয়া যায় না। অত্যন্ত গোপনে যৎ-সামান্য চোরাচালান আসে। পরিধেয়-বস্ত্র প্রায় নেই বললেই চলে। সকলেই এক কাপড় সম্বল। এর ভেতরেও নিয়মিত পরামর্শ চলছে কী করে উদ্ধার পাওয়া যায়। জাহাজ থেকে নদীর একদিক দেখা যাবে ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ। জাহাজের ডেকে পরামর্শরত ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক এবং আরও দুজন তরুণ ইংরেজ।)

ড্রেক : এই তো কিলপ্যাট্রিক ফিরে এসেছেন মাদ্রাজ থেকে। ওঁর কাছেই শোনো, প্রয়োজনীয় সাহায্য-

হ্যারি : এসে পড়ল বলে, এই তো বলতে চাইছেন? কিন্তু সে সাহায্য এসে পৌঁছোবার আগেই আমাদের দফা শেষ হবে মি. ড্রেক। 

মার্টিন : কিলপ্যাট্রিক সাহেবের সুখবর নিয়ে আসাটা আপাতত আমাদের কাছে মোটেই সুখবর নয়। তিনি মাত্র শআড়াই সৈন্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। এই ভরসায় একটা দাঙ্গাও করা যাবে না। যুদ্ধ করে কলকাতা জয় তো দূরের কথা।

ড্রেক : তবু তো লোকবল কিছুটা বাড়ল।

হ্যারি : লোকবল বাড়–ক আর না বাড়–ক আহার্যের অংশীদার বাড়ল তা অবশ্য ঠিক।

ড্রেক : আহার্য কোনো রকমের জোগাড় হবেই।

মার্টিন : কী করে হবে তাই বলুন মি. ড্রেক। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎটাই তো জানতে চাইছি। এ পর্যন্ত দুবেলা আহার্যের বন্দোবস্ত হয়েছে? ধারে কাছে হাটবাজার নেই। নবাবের হুকুমে প্রকাশ্যে কেউ কোনো জিনিস আমাদের কাছে বেঁচেও না। চারগুণ দাম দিয়ে গোপনে সওদাপাতি কিনতে হয়। এই অবস্থা কতদিন চলবে সেটা আমাদের জানা দরকার।

কিলপ্যাট্রিক : এত অল্পে অধৈর্য হলে চলবে কেন?

হ্যারি : ধৈর্য ধরব আমরা কিসের আশায় সেটাও তো জানতে হবে।

ড্রেক : যা হয়েছে তা নিয়ে বিবাদ করে কোনো লাভ নেই। দোষ কারো একার নয়।

মার্টিন : যাঁরা এ পর্যন্ত হুকুম দেবার মালিক তাঁদের দোষেই আজ আমরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত। বিশেষ করে আপনার হঠকারিতার জন্যেই আজ আমাদের এই দুর্ভোগ।

ড্রেক : আমার হঠকারিতা?

মার্টিন : তা নয়ত কী? অমন উদ্ধত ভাষায় নবাবকে চিঠি দেবার কী প্রয়োজন ছিল? তা ছাড়া নবাবের আদেশ অমান্য করে কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দেবারই বা কী কারণ?

ড্রেক : সব ব্যাপারে সকলের মাথা গলানো সাজে না।

হ্যারি : তা তো বটেই। কৃষ্ণবল্লভের কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা উৎকোচ নেবেন মি. ড্রেক, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাবো কেন? কিন্তু এটা বলতে আমাদের কোনো বাধা নেই যে, ঘুষের অঙ্ক বড় বেশি মোটা হবার ফলেই নবাবের ধমকানি সত্তে¡ও কৃষ্ণবল্লভকে ত্যাগ করতে পারেননি মি. ড্রেক।

ড্রেক : আমার রিপোর্ট আমি কাউন্সিলের কাছে দাখিল করেছি।

মার্টিন : রিপোর্টের কথা রেখে দিন। তাতে আর যাই থাক সত্যি কথা বলা হয়নি। (টেবিলের ওপর এক বান্ডিল কাগজ দেখিয়ে) ওই তো রিপোর্ট তৈরি করেছেন কলকাতা যে ডুবিয়ে দিয়ে এসেছেন তার। ওর ভেতরে একটি বর্ণ সত্যি কথা খুঁজে পাওয়া যাবে?

ড্রেক : (টেবিলে ঘুসি মেরে) That's none to your business. 

মার্টিন : Of course it is.

কিলপ্যাট্রিক : তোমরাই বা হঠাৎ এমন সাধুত্বের দাবিদার হলে কিসে?

ড্রেক : তোমাদের দুজনের Bank balance বিশ হাজারের কম নয় কারুরই। অথচ তোমরা কোম্পানির সত্তর টাকা বেতনের কর্মচারী।

হ্যারি : ব্যক্তিগত উপার্জনের ছাড়পত্র কোম্পানি সকলকেই দিয়েছে। সবাই উপার্জন করছে, আমরাও করছি। কিন্তু আমরা ঘুষ খাইনি।

ড্রেক : আমিও ঘুষ খাইনে।

মার্টিন : অর্থাৎ ঘুষ খেয়ে খেয়ে ঘুষ কথাটার অর্থই বদলে গেছে আপনার কাছে।

ড্রেক : তোমরা বেশি বাড়াবাড়ি করছ। ভুলে যেও না এখনও ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃত্ব আমার হাতে।

হ্যারি : ফোর্ট উইলিয়াম?

ড্রেক : ইংরেজের আধিপত্য অত সহজেই মুছে যাবে নাকি? এই জাহাজটাই এখন আমাদের কলকাতার দুর্গ। আর দুর্গ শাসনের ক্ষমতা এখনও আমার অধিকারে। বিপদের সময়ে সকলে একযোগে কাজ করার জন্যেই মন্ত্রণা সভায় তোমাদের ডেকেছিলাম। কিন্তু দেখছি তোমরা এই মর্যাদার উপযুক্ত নও।

মার্টিন : বড়াই করে কোনো লাভ হবে না মি. ড্রেক। আমরা আপনার কর্তৃত্ব মানব না। 

ড্রেক : এতবড় স্পর্ধা? Withdraw. Why you have said মাফ চাও দ্বিতীয় কথা না বলে।| Nothing sort of an unconditional apology will save you.. মাফ চাও তা না হলে এই মুহূর্তে তোমাদের কয়েদ করবার হুকুম দিয়ে দেব। ( জনৈক ইংরেজ মহিলা দড়ির ওপর একটা ছেঁড়া গাউন মেলতে আসছিলেন। তিনি হঠাৎ ড্রেকের কথায় রুখে উঠলেন। ছুটে গেলেন বচসারত পুরুষদের কাছে।)

রমণী : তবু যদি মেয়েদের নৌকোয় করে কলকাতা থেকে না পালাতেন তা হলেও না হয় এই দম্ভ সহ্য করা যেত।

ড্রেক :  We are in the council Session, madam. এখানে মহিলাদের কোনো কাজ নেই।

রমণী : Damn your Council, প্রাণ বাঁচবে কী করে তার ব্যবস্থা নেই, কর্তৃত্ব ফলাচ্ছেন সব।

ড্রেক : সেই ব্যবস্থাই তো হচ্ছে।

রমণী : ছাই হচ্ছে। রোজই শুনছি কিছু একটা হচ্ছে। যা হচ্ছে সে তো নিজেদের ভেতরে ঝগড়া। এ-দিকে দিনের পর দিন একবেলা খেয়ে, প্রায়ই না খেয়ে অহোরাত্র এক কাপড় পরে মানুষের মনুষ্যত্ব ঘুচে যাবার জোগাড়।

ড্রেক : But you see-

রমণী :I do not see alone, you can also see every night. 

এক প্রস্থ জামা কাপড় সম্বল। ছেলেবুড়ো সকলকেই তা খুলে রেখে রাত্রে ঘুমুতে হয়। কোনো আড়াল নেই, আব্রু নেই। এর চেয়ে বেশি আর কী দেখাতে চান? হাতের ভিজা গাউনটা ড্রেকের মুখে ছুঁড়ে দিতে যাচ্ছিলেন মহিলাটি, এমন সময় জনৈক গোরা সৈনিকের দ্রুত প্রবেশ।

সৈনিক : মি. হলওয়েল আর মি. ওয়াটস।

                                                                               (প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হলওয়েল আর ওয়াটস ঢুকলো)

কিলপ্যাট্রিক : God gracious.

হলওয়েল : (সকলের উদ্দেশ্যে) Good morning to you.

 (সকলের সঙ্গে করমর্দন। ওয়াটস কোনো কথা না বলে সকলের সঙ্গে করমর্দন করল। মহিলাটি একটু ইতস্তত করে অন্যদিকে চলে গেলেন।)

ড্রেক : বলো, খবর বলো হলওয়েল। উৎকণ্ঠায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো যে।

হলওয়েল : মুর্শিদাবাদে ফিরেই নবাব আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। অবশ্য নানা রকম ওয়াদা করতে হয়েছে, নাকে-কানে খৎ দিতে হয়েছে এই যা।

ড্রেক : কলকাতায় ফেরা যাবে?

হলওয়েল : না।

ওয়াটস : আপাতত নয়, কিন্তু ধীরে ধীরে হয়ত একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কিলপ্যাট্রিক : কী রকম ব্যবস্থা?

ওয়াটস : অর্থাৎ মেজাজ বুঝে যথাসময়ে কিছু উপঢৌকনসহ হাজির হয়ে আবার একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

ড্রেক : তার জন্যে কতকাল অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।

হলওয়েল : একটা ব্যাপার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নবাব ইংরেজদের ব্যবসা সমুলে উচ্ছেদ করতে চান না। তা চাইলে এভাবে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারতেন না।

ড্রেক : তা হলে নবাবের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাটা করে ফেলতে হয়।

হলওয়েল : কিছুটা করেই এসেছি। তা ছাড়া উমিচাঁদ নিজের থেকেই আমাদের সাহায্য করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে।

ড্রেক :Hurray!

ওয়াটস : মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ এঁরাও আস্তে আস্তে নবাবের কানে কথাটা তুলবেন। 


ড্রেক : (হ্যারি ও মার্টিনকে) আশা করি তোমাদের মেজাজ এখন কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। আমাদের মিলেমিশে থাকতে হবে, একযোগে কাজ করতে হবে।

হ্যারি : আমরা তো ঝগড়া করতে চাইনে। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ জানতে চাই।

মার্টিন : যেমন হোক একটা নিশ্চিত ফল দেখতে চাই।

                                                                                                                               (উভয়ের প্রস্থান)

ড্রেক : (উচ্চ কণ্ঠে) Patience is the key-word youngmen

হলওয়েল : (পায়ে চাপড় মেরে) উঃ, কী মশা।

ড্রেক : যা বলেছো। ম্যালেরিয়া আর আমাশয়ে ভুগে কয়েকজন এর ভেতরে মারাও গেছে।

ওয়াটস : বড় ভয়ানক জায়গায় আস্তানা গেড়েছেন আপনারা।

ড্রেক : But it is important from military point of view. সমুদ্র কাছেই। কলকাতাও চল্লিশ মাইলের ভেতরে। প্রয়োজন হলে যে কোনো দিকে ধাওয়া করা যাবে।

কিলপ্যাট্রিক :Thats true. কলকাতায় ফেরার আশায় বসে থাকতে হলে এই জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল। সেদিক দিয়ে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই, বিপদ যদি আসেই তা হলে তা আসবে কলকাতার দিক দিয়ে গঙ্গার স্রোতে ভেসে। কাজেই সতর্ক হবার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে।

হলওয়েল : কলকাতার দিক থেকে আপাতত কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। উমিচাঁদ কলকাতার দেওয়ান মানিকচাঁদকে হাত করেছে। তার অনুমতি পেলেই জঙ্গল কেটে আমরা এখানে হাট-বাজার বসিয়ে দেবো।

ড্রেক : নেটিভরা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু ফৌজদারে ভয়েই তা পারছে না।

 (প্রহরী সৈনিকের প্রবেশ। সে ড্রেকের হাতে এক টুকরা কাগজ দিল। ড্রেক কাগজ পড়ে চেঁচিয়ে উঠল) উমিচাঁদের লোক এই চিঠি এনেছে।

সকলে : What ? এত তাড়াতাড়ি।

ড্রেক : (মাঝে মাঝে উচ্চৈঃস্বরে পত্র পড়তে লাগল) ‘আমি চিরকালই ইংরেজের বন্ধু। মৃত্যু পর্যন্ত এই বন্ধুত্ব আমি বজায় রাখিব। মানিকচাঁদকে অনেক কষ্টে রাজি করানো হইয়াছে। সে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসা করিবার অনুমতি দিয়াছে। এর জন্য তাহাকে বারো হাজার টাকা নজর দিতে হইয়াছে। টাকাটা নিজের তহবিল হইতে দিয়া দেওয়ানের স্বাক্ষরিত হুকুমনামা হাতে হাতে সংগ্রহ করিয়া পত্রবাহক মারফত পাঠাইলাম। 

এই টাকা এবং আমার পারিশ্রমিক ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ যাহা ন্যায্য বিবেচিত হয় তাহা পত্রবাহকের হাতে পাঠাইলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকিব। বলা বাহুল্য, পারিশ্রমিক বাবদ আমি পাঁচ হাজার টাকা পাইবার আশা করি। সুদূর লাহোর হইতে আমি বাংলাদেশে আসিয়াছি অর্থ উপার্জনের জন্য, যেমন আসিয়াছেন কোম্পানির লোকেরা। কাজেই উদ্দেশ্যের দিক দিয়া বিচার করলে আমি আপনাদেরই সমগোত্রীয়। (চিঠি ভাঁজ করতে করতে) A Perfect scoundrel is this Omichand.

হলওয়েল : কিন্তু উমিচাঁদের সাহায্য তো হাতছাড়া করা যাচ্ছে না।

ওয়াটস :Even when it is too costly

ড্রেক : সেই তো মুস্কিল। ওর লোভের অন্ত নেই। মানিকচাঁদের হুকুমনামার জন্যে সতের হাজার টাকা দাবি করেছে। আমি হলপ করে বলতে পারি দুহাজারের বেশি মানিকচাঁদের পকেটে যাবে না। বাকিটা যাবে উমিচাঁদের তহবিলে।

হলওয়েল : কিন্তু কিছুই করবার নেই। উপযুক্ত অবস্থার সুযোগ পেয়ে সে ছাড়বে কেন?

ড্রেক : দেখি, টাকাটা দিয়ে ওর লোকটাকে বিদায় করি।

                                                                                                         (বেরিয়ে গেল)

ওয়াটস : শুধু উমিচাঁদের দোষ দিয়ে কী লাভ? মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, মানিকচাঁদ কে হাত পেতে নেই?

কিলপ্যাট্রিক : দশদিকের দশটি খালি হাত ভর্তি করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ইংরেজ, ডাচ আর ফরাসিরা।

হলওয়েল : কিছু না, কিছু না। হাজার হাতে হাজার হাজার হাত থেকে নিয়ে দশ হাত বোঝাই করতে আর কতটুকু সময় লাগে? বিপদ সেখানে নয়। বিপদ হল বখরা নিয়ে মতান্তর ঘটলে। (ড্রেকের প্রবেশ) 

ড্রেক : (উমিচাঁদের চিঠি বার করে) আর একটা জরুরি খবর আছে উমিচাঁদের চিঠিতে। শওকতজঙ্গের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার লেগে গেল বলে। এই সুযোগ নেবে মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠের দল। তারা শওকতজঙ্গকে সমর্থন করবে।

ওয়াটস : খুব স্বাভাবিক। শওকতজঙ্গ নবাব হলে সকলের উদ্দেশ্যই হাসিল হবে। ভাং খেয়ে নাচওয়ালিদের নিয়ে সারাক্ষণ সে পড়ে থাকবে আর উজির ফৌজদাররা যার যা খুশি তাই করতে পারবে।

ড্রেক : আগে ভাগেই তার কাছে আমাদের ভেট পাঠানো উচিৎ বলে আমার মনে হয়।।

কিলপ্যাট্রিক : I send you

ওয়াটস : তা পাঠান। কিন্তু সন্ধ্যে হয়ে গেল যে। এখানে একটা বাতি দেবে না?

ড্রেক : (আরদালি) বাত্তি লে আও।

হলওয়েল : নবাবের কয়েদখানায় থেকে এ দুদিনে শুকিয়ে মরুভ‚মি হয়ে গেছি। আপনাদের অবস্থা কি ততটাই খারাপ?

ড্রেক : Not so bad I hope.

                                                                 (আর্দালি একটা বাতি রাখলো)

ড্রেক : পেগ লাগাও।

                                                                (দূরে থেকে কণ্ঠস্বর)

নেপথ্যে : জাহাজ-জাহাজ আসছে। চারজনে

সমস্বরে : কোথায়? From which side?

নেপথ্যে : সমুদ্রের দিক থেকে জাহাজ আসছে। দুখানা, তিন খানা, চার খানা, পাঁচখানা। পাঁচখানা জাহাজ। কোম্পানির জাহাজ!

                                                                     (আর্দালি বোতল আর গ্লাস রাখল টেবিলে)

ড্রেক : কোম্পানির জাহাজ? ? Must be from Madras. Let us celebrate. Hip Hip Hurray.

সমস্বত্তে  : Hurray 

                                                                                                    (সবাই গ্লাসে মদ ঢেলে নিল)

প্রথম অংক: তৃতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৬ সাল ১০ অক্টোবর। স্থান : ঘসেটি বেগমের বাড়ি।

[চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- ঘসেটি বেগম, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রাইসুল জুহালা, রায় দুর্লভ, প্রহরী, সিরাজ, মোহনলাল, নর্তকী, বাদকগণ।]

(প্রৌঢ়া ঘসেটি  জাঁকজমকপূর্ণ জলসার সাজে সজ্জিতা। আসরে উপস্থিত রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, বাদক এবং নর্তকী। সুসজ্জিত খানসামা তাম্বুল এবং তাম্রকূট পরিবেশন করছে। একজন বিচিত্রবেশী অতিথি রাইসুল জুহালার সঙ্গে আসরে প্রবেশ করল উমিচাঁদ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ের নাচ শেষ হল। সকলের হাততালি।) 

ঘসেটি : বসুন উমিচাঁদজি। সঙ্গের মেহমানটি আমাদের অচেনা বলেই মনে হচ্ছে।

উমিচাঁদ : (যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে) মাফ করবেন বেগম সাহেবা, ইনি একজন জবরদস্ত শিল্পী। আমার সঙ্গে অল্পদিনের পরিচয় কিন্তু তাতেই আমি এঁর কেরামতিতে একেবারে মুগ্ধ। আজকের জলসা সরগরম করে তুলতে পারবেন আশা করে এঁকে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি।

রাজবল্লভ : তাহলেও এখানে একজন অপরিচিত মেহমান-

উমিচাঁদ : না না সে সব কিছু ভাবতে হবে না। দরিদ্র শিল্পী, পেটের ধান্দায় আসরে জলসায় কেরামতি দেখিয়ে বেড়ান।

জগৎশেঠ : তাহলে আরম্ভ করুন ওস্তাদজি। দেখি নাচওয়ালিদের ঘুঙুর এবং ঘাগরা বাদ দিয়ে আপনার কাজের তারিফ করা যায় কিনা।

                                    (ঘসেটি ও রাজবল্লভের দৃষ্টি বিনিময়। আগন্তুক আসরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল)

রাজবল্লভ : ওস্তাদজির নামটা-

আগন্তুক : রাইসুল জুহালা। (সকলের উচ্চহাসি)

রায়দুর্লভ : জাহেলদের রইস। এই নামের গৌরবেই আপনি উমিচাঁদজিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন                             নাকি?

                                                                                                        (আবার সকলের হাসি)

উমিচাঁদ : (ইষৎ রুষ্ট) আমি তো বেশক জাহেল। তা না হলে আপনারা সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফ শুকনো রাখেন, আর আমি দুধের হাঁড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাঁড়ির কালি মেখে গুলবাঘা বনে যাই।

ঘসেটি : আপনারা বড় বেশি কথা কাটাকাটি করেন। শুরু করুন ওস্তাদজি।

রাইসুল জুহালা : য্যায়সা হুকুম। আমি নানা রকমের জন্তু জানোয়ারের আদব কায়দা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল। আপতত আমি আপনাদের একটা নাচ দেখাবো। পক্ষীকূলের একটি বিশেষ শ্রেণি, ধার্মিক হিসেবে যার জবরদস্ত নাম, সেই পাখির নৃত্যকলা আপনারা দেখবেন। দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে এই বিশেষ নৃত্যটি আমি জনপ্রিয় করতে চাই। 

( তবলচিকে একটু ঠেকা দিয়ে দিন। (তাল বলে দিল। নৃত্য শুরু করল। নৃত্য চলাকালে ঘসেটি এবং রাজবল্লভ নিচুস্বরে পরামর্শ করলেন। পরে উমিচাঁদ এবং রাজবল্লভ কিছু আলোচনা করলেন। নাচ শেষ হলে সকলের হর্ষ প্রকাশ।)

রাজবল্লভ : ওস্তাদজি জবরদস্ত লোক মনে হচ্ছে। ওঁকে আরও কিছু কেরামতি দেখাবার দায়িত্ব দিলে কেমন হয়?

 (উমিচাঁদ রাইসুল জুহালাকে একপাশে ডেকে নিয়ে কিছু বলল। তারপর নিজের আসনে ফিরে এলো)

উমিচাঁদ : উনি রাজি আছেন। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে কলাকৌশল দেখাবার ফাঁকে ফাঁকে দুচারখানা চিঠিপত্রের আদান প্রদান করতে ওঁর আপত্তি নেই।

রাজবল্লভ : তাহলে এখন ওঁকে বিদায় দিন। পরে দরকার মতো কাজে লাগানো হবে।

রাইসুল জুহালা: বহোত আচ্ছা হুজুর।

                                                        (সবাইকে সালাম করে কালোয়াতি করতে করতে বেরিয়ে গেল)

ঘসেটি : তাহলে আবার নাচ শুরু হোক?

রাজবল্লভ : আমার মনে হয় নাচওয়ালিদের কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিয়ে কাজের কথা সেরে নেওয়াই ভালো।

ঘসেটি : তাই হোক

                                                                             (ইঙ্গিত করতেই দলবলসহ নাচওয়ালিদের প্রস্থান)

রায়দুর্লভ : বেগম সাহেবাই আরম্ভ করুন।

ঘসেটি : আপনারা তো সব জানেন। এখন খোলাখুলিভাবে যার যা বলার আছে বলুন।

জগৎশেঠ : সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শওকতজঙ্গকে আমরা পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছি। কিন্তু শওকতজঙ্গ নবাব হলে আমি কী পাবো তা আমাকে পরিষ্কার করে বলুন।

ঘসেটি : শওকতজঙ্গ আপনাদেরই ছেলে। সে নবাবি পেলে প্রকারান্তরে আপনারাই তো দেশের মালিক হয়ে বসবেন।

রায়দুর্লভ : এটা কোনো কথা হলো না। যিনি নবাব হবেন-

জগৎশেঠ : আমার কথা আগে শেষ হোক দুর্লভরাম।

রায়দুর্লভ : বেশ আপনার কথাই শেষ করুন। কিন্তু মনে রাখবেন কথা শেষ হবার পর আর কোনো কথা উঠবে না।

জগৎশেঠ : সে আবার কী কথা?

রাজবল্লভ : আপনারা তর্কের ভিতরে যাচ্ছেন আলোচনা শুরু করার আগেই। খুব সংক্ষেপে কথা শেষ করা দরকার। বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের আলোচনা দীর্ঘ করা বিপজ্জনক।

জগৎশেঠ : কথা ঠিক। কিন্তু নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে একটা বিপদের ঝুঁকি নিতে যাওয়াটাও তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মাফ করবেন বেগম সাহেবা, আমি খোলাখুলিই বলছি। অস্বীকার করে লাভ নেই যে শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাংয়ের গেলাস এবং নাচওয়ালি ছাড়া সে আর কিছুই জানে না। কাজেই শওকতজঙ্গ নবাব হবে নামমাত্র। আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগম সাহেবার এবং পরোক্ষে তাঁর নামে দেশ শাসন করবেন।

রায়দুর্লভ : ঠিক এই ধরনের একটা সম্ভাবনার উল্লেখ করার ফলেই হোসেনকুলি খাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। 

জগৎশেঠ : আমি তা বলছিনে। তাছাড়া এখানে সে কথা অবান্তর। আমি বলতে চাইছি যে, শওকতজঙ্গ নবাবি পেলে বেগম সাহেবা এবং রাজা রাজবল্লভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘ্ন হবে আমাদের তেমন আশা নেই। কাজেই আমাদের পক্ষে নগদ কারবারই ভালো।

ঘসেটি : ধনকুবের জগৎশেঠকে নগদ অর্থ দিতে হলে শওকতজঙ্গের যুদ্ধের খরচ চলবে কী করে?

জগৎশেঠ : না না আমি নগদ টাকা চাইছি নে। যুদ্ধের খরচ বাবদ টাকা আমি দেবো অবশ্য আমার যা সাধ্য। কিন্তু আসল এবং লাভ মিলিয়ে আমাকে একটা কর্জনামা সই করে দিলেই আমি নিশ্চিত হতে পারি।

রায়দুর্লভ : আমাকেও পদাধিকারের একটা একরারনামা সই করে দিতে হবে।

                                                                             (প্রহরীর প্রবেশ। ঘসেটি বেগমের হাতে পত্র দান)

ঘসেটি : (চিঠি খুলতে খুলতে) সিপাহসালার মিরজাফরের পত্র পড়তে পড়তে) তিনি শওকতজঙ্গকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং অবিলম্বে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার পরামর্শ দিয়েছেন।

রাজবল্লভ : বহোত খুব।

উমিচাঁদ : আমার তো কোনো বিষয়ে কোনো দাবি দাওয়া নেই, আমি সকলের খাদেম। খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই নিই। কাজেই এতক্ষণ আমি চুপ করেই আছি।

ঘসেটি : আপনারও যদি কিছু বলার থাকে এখুনি বলে ফেলুন।

উমিচাঁদ : নিজের সম্বন্ধে কিছু নয়। তবে সিপাহসালারের প্রস্তুতি আমার পছন্দ হয়েছে তাই বলছি। ইংরেজরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছে। সিরাজউদ্দৌলার পতনই তাদের কাম্য। শওকতজঙ্গ এখুনি যদি আঘাত হানতে পারেন, তিনি ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পাবেন। ফলে জয় তাঁর অবধারিত।

ঘসেটি : সিরাজের পতন কে না চায়?

উমিচাঁদ : অন্তত আমরা চাই। কারণ সিরাজউদ্দৌলার নবাবিতে নির্বিঘ্ন হতে পারলে আমাদের সকলের স্বার্থই রাহুগ্রস্ত হবে।

ঘষেটি : সিরাজ সম্বন্ধে উমিচাঁদের বড় বেশি আশঙ্কা।

উমিচাঁদ : কিছুমাত্র নয় বেগম সাহেবা। দওলৎ আমার কাছে ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়। আমি দওলতের পূজারী। তা না হলে সিরাজউদ্দৌলাকে বাতিল করে শওকতজঙ্গকে চাইব কেন? আমি কাজ কতদূর এগিয়ে এসেছি এই দেখুন তার প্রমাণ।

                                                                        (পকেট থেকে চিঠি বার করে ঘসেটি বেগমের হাতে দিল)

ঘসেটি : (চিঠির নিচে স্বাক্ষর দেখে উল্লসিত হয়ে) এ যে ড্রেক সাহেবের চিঠি।

উমিচাঁদ : আমার প্রস্তাব অনুমোদন করে তিনি জবাব দিয়েছেন।

ঘসেটি : (পত্র পড়তে পড়তে) লিখেছেন শওকতজঙ্গ যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের সেনাবাহিনীতে যেন বিদ্রোহ ঘটানো হয়। আমাদের মিত্র সেনাপতিদের অধীনস্থ ফৌজ যেন রাজধানী আক্রমণ করে। তাহলে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।

রাজবল্লভ : আমাদের বন্ধু সিপাহসালার মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান ইচ্ছে করলেই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন।

 (হঠাৎ বাইরে তুমুল কোলাহল। সকলেই সচকিত। ঘসেটি বেগম কোলাহলের কারণ জানবার জন্যে বাইরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ বাহির থেকে নবাব শব্দটি কানে যেতেই রাজবল্লভ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে নাচওয়ালিদের ডেকে পাঠালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তারা সদলবলে কামরায় এলো।)

রাজবল্লভ : আরম্ভ করো জলদি। (ঘুঙুরের আওয়াজ উঠবার পর পরই সবেগে কামরায় ঢুকলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পেছনে মোহনলাল। সবাই তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়ালো। নাচওয়ালিদের নাচ থেমে গেলো।)

ঘসেটি : (ভীতিরুদ্ধ কন্ঠে) নবাব!

সিরাজ : কী ব্যাপার খালাআম্মা, বড়ো ভারী জলসা বসিয়েছেন?

ঘসেটি : (আত্মস্থ হয়ে) এ রকম জলসা এই নতুন নয়।

সিরাজ : তা নয়, তবে বাংলাদেশের সেরা লোকেরাই শুধু শামিল হয়েছেন বলে জলসার রোশনাই আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। 

ঘসেটি : নবাব কি নাচগানের মজলিস মানা করে দিয়েছেন?

সিরাজ : নাচগানের মহফিলের জন্যে দেউড়িতে কড়া পাহারা বসিয়ে রেখেছেন খালাআম্মা। তারা তো আমার ওপরে গুলিই চালিয়ে দিয়েছিল প্রায়। দেহরক্ষী ফৌজ সঙ্গে না থাকলে এই জলসায় এতক্ষণে মর্সিয়া শুরু করতে হতো।

                                                                             (হঠাৎ কণ্ঠস্বরে অবিচল তীব্রতা ঢেলে)

 রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, আপনারা এখন যেতে পারেন। মতিঝিলের জলসা আমি চিরকালের মতো ভেঙে দিলাম। (ঘসেটি বেগমকে) তৈরি হয়ে নিন খালাআম্মা। আপনাকে আমি প্রাসাদে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার চারিদিকে যড়যন্ত্রের জাল। এ সময়ে নবাবের খালাআম্মার পক্ষে প্রাসাদের বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।

ঘসেটি : (রোষে চিৎকার করে) তুমি আমাকে বন্দি করে নিয়ে যেতে এসেছো? তোমার এতখানি স্পর্ধা?

সিরাজ : এতে ক্রুদ্ধ হবার কী আছে? আম্মা আছেন, আপনিও তাঁর সঙ্গেই প্রাসাদে থাকবেন।

ঘসেটি : মতিঝিল ছেড়ে আমি এক পা নড়ব না। তোমার প্রাসাদে যাবো? তোমার প্রাসাদ বাজ পড়ে খান খান হয়ে যাবে। (সহসা কাঁদতে আরম্ভ করলেন)

সিরাজ : (অবিচলিত) তৈরি হয়ে নিন খালাআম্মা। আপনাকে আমি নিয়ে যাবো।

ঘসেটি : (মাতম করতে করতে) রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, বিধবার ওপরে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপনারা কিছুই করতে পারছেন না?

রাজবল্লভ : (একটু ইতস্তত করে) জাঁহাপনা কি সত্যিই-সিরাজ : (উত্তপ্ত) আপনাদের চলে যেতে বলেছি রাজা রাজবল্লভ। নবাবের হুকুম অমান্য করা রাজদ্রোহিতার শামিল। আশা করি অপ্রিয় ঘটনার ভেতর দিয়ে তা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।

 (রাজবল্লভ প্রভৃতি প্রস্থানোদ্যত) হ্যাঁ, শুনুন রায়দুর্লভ, শওকতজঙ্গকে আমি বিদ্রোহী ঘোষণা করেছি। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে মোহনলালের অধীনে সেনাবাহিনী পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি। আপনি তৈরি থাকবেন। প্রয়োজন হলে আপনাকেও মোহনলালের অনুগামী হতে হবে।

রায়দুর্লভ : হুকুম জাঁহাপনা। (তারা নিষ্ক্রান্ত হলো। ঘসেটি বেগম হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন)

সিরাজ : মোহনলাল আপনাকে নিয়ে আসবে, খালাআম্মা। আপনার কোনো রকম অমর্যাদা হবে না।

                                                                                                (বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন)

ঘসেটি : তোমার ক্ষমতা ধ্বংস হবে, সিরাজ। নবাবি? নবাবি করতে হবে না বেশিদিন। কেয়ামত নাজেল হবে। আমি তা দেখব-দেখব। ঘসেটি : নবাব কি নাচগানের মজলিস মানা করে দিয়েছেন?

সিরাজ : নাচগানের মহফিলের জন্যে দেউড়িতে কড়া পাহারা বসিয়ে রেখেছেন খালাআম্মা। তারা তো আমার ওপরে গুলিই চালিয়ে দিয়েছিল প্রায়। দেহরক্ষী ফৌজ সঙ্গে না থাকলে এই জলসায় এতক্ষণে মর্সিয়া শুরু করতে হতো।

                                                                                 (হঠাৎ কণ্ঠস্বরে অবিচল তীব্রতা ঢেলে)

 রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, আপনারা এখন যেতে পারেন। মতিঝিলের জলসা আমি চিরকালের মতো ভেঙে দিলাম। (ঘসেটি বেগমকে) তৈরি হয়ে নিন খালাআম্মা। আপনাকে আমি প্রাসাদে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার চারিদিকে যড়যন্ত্রের জাল। এ সময়ে নবাবের খালাআম্মার পক্ষে প্রাসাদের বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।

ঘসেটি : (রোষে চিৎকার করে) তুমি আমাকে বন্দি করে নিয়ে যেতে এসেছো? তোমার এতখানি স্পর্ধা?

সিরাজ : এতে ক্রুদ্ধ হবার কী আছে? আম্মা আছেন, আপনিও তাঁর সঙ্গেই প্রাসাদে থাকবেন।

ঘসেটি : মতিঝিল ছেড়ে আমি এক পা নড়ব না। তোমার প্রাসাদে যাবো? তোমার প্রাসাদ বাজ পড়ে খান খান হয়ে যাবে। (সহসা কাঁদতে আরম্ভ করলেন)

সিরাজ : (অবিচলিত) তৈরি হয়ে নিন খালাআম্মা। আপনাকে আমি নিয়ে যাবো।

ঘসেটি : (মাতম করতে করতে) রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, বিধবার ওপরে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপনারা কিছুই করতে পারছেন না?

রাজবল্লভ : (একটু ইতস্তত করে) জাঁহাপনা কি সত্যিই-

সিরাজ : (উত্তপ্ত) আপনাদের চলে যেতে বলেছি রাজা রাজবল্লভ। নবাবের হুকুম অমান্য করা রাজদ্রোহিতার শামিল। আশা করি অপ্রিয় ঘটনার ভেতর দিয়ে তা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।

 (রাজবল্লভ প্রভৃতি প্রস্থানোদ্যত) হ্যাঁ, শুনুন রায়দুর্লভ, শওকতজঙ্গকে আমি বিদ্রোহী ঘোষণা করেছি। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে মোহনলালের অধীনে সেনাবাহিনী পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি। আপনি তৈরি থাকবেন। প্রয়োজন হলে আপনাকেও মোহনলালের অনুগামী হতে হবে।

রায়দুর্লভ : হুকুম জাঁহাপনা। (তারা নিষ্ক্রান্ত হলো। ঘসেটি বেগম হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন)

সিরাজ : মোহনলাল আপনাকে নিয়ে আসবে, খালাআম্মা। আপনার কোনো রকম অমর্যাদা হবে না।

                                                                                        (বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন)

ঘসেটি : তোমার ক্ষমতা ধ্বংস হবে, সিরাজ। নবাবি? নবাবি করতে হবে না বেশিদিন। কেয়ামত নাজেল হবে। আমি তা দেখব-দেখব। 

শব্দের অর্থ 

অকর্মণ্য--যে কোনো কাজ করে না। কর্মক্ষম নয় এমন, অপটু। 

অহোরাত্র-- দিবারাত্রি, সর্বক্ষণ। 

আকীর্ণ-- পরিপূর্ণ।

আরদালি-- চাপরাশি, পিওন। 

আব্রু --আবরণ, পর্দা। 

ইতস্তত-- দ্বিধা, সঙ্কোচ। 

একরারনামা-- স্বীকারনামা বা কবুলনামা।

ওয়াকিফহাল-- বিশেষ অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত বা অভিজ্ঞ। 

করমর্দন-- হাতে হাতে প্রীতিমূলক বিশেষ মিলন বা স্পর্শ।

কয়েদখানা-- কারাগার, বন্দিশালা। 

কালোয়াতী-- উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে নৈপুণ্য, রাগ সঙ্গীতে পারদর্শিতা। 

কেরামতি-- ক্ষমতা,শক্তি, প্রতাপ। 

কেয়ামত-- ইসলাম ধর্মমতে প্রলয়ের দিন, প্রলয়, ধ্বংস। 

কোম্পানি-- ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সংক্ষিপ্ত নাম।

গোলন্দাজ-- যে সৈনিক কামান দাগিয়ে গোলা নিক্ষেপ করে। 

জবরদস্ত-- শক্তিশালী, জোরালো। 

জুলুম-- অত্যাচার।

ডাচদের-- ওলন্দাজ বা হল্যান্ডের কর্মচারীদের। 

ড্রেক-- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভর্নর রজার ড্রেক। 

তহবিল-- সঞ্চিত নগদ টাকা কড়ি। 

তারিফ-- প্রশংসা। 

তাম্রকুট-- তামাক। 

তাম্বুল-- পান। 

দত্তলৎ-- দৌলত, ধন-সম্পদ। 

দুরবস্থা-- খারাপ অবস্থা।

দেউড়ি-- উঠান। 

ধনকুবের-- ধনবান, বিত্তশালী। 

ধান্দা-- ধাঁধা, ধোঁকা, প্রতারণা, এখানে জীবিকার প্রচেষ্টা। 

নাজেল--অবতরণ, আবির্ভাব। 

ফৌজদার-- সেনানায়ক, আঞ্চলিক শাসক। 

ভাঙ-- এক ধরনের মাদক। 

মনুষ্যত্ব-- মানবিক গুণাবলী।

রাজদ্রোহিতা-- রাজা বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। 

রোশনাই-- জ্যোতি, আলো। 

সরগরম-- জমজমাট, পরিপূর্ণ।

সপাহসালার-- সেনাপতি। 

সর্বাধিনায়ক-- যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। 

হাতুড়ে-- আনাড়ি চিকিৎসক। 

Celebrate--উদ্যাপন করা। 

Gracious--করুণাময়, সদয়, দয়াশীল। 

Scoundrel--নীচমনা, ইতর, নীতিবর্জিত মানুষ। 

 Secret Committee --গোপন সংস্থা, গোপন পরিষদ।

আলিবর্দি-- প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলিবর্দি খাঁ। বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতামহ। তিনি ছিলেন সুদক্ষ শাসক। তিনিই মৃত্যুর সময় সিরাজকে ভবিষ্যৎ নবাব হওয়ার কথা বলে যান।

ওয়াটস-- উইলিয়াম ওয়াটস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাশিমবাজার কুঠির পরিচালক। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।

উর্মিচাঁদ-- লাহোরের অধিবাসী উমিচাঁদ ধর্ম বিশ্বাসে ছিলেন শিখ। ইংরেজদের সঙ্গে দালালী করে উমিচাঁদ সিরাজের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন।

জগৎশেঠ-- জগৎশেঠ কোন নাম নয়, উপাধি। ১৭২৩ সালে দিল্লীর সম্রাট মানিক চাঁদের ভ্রাতুষ্পুত্র ফতেহ চাঁদকে জগৎশেঠ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। পলাশির যুদ্ধের সময় জগৎশেঠ সিরাজের বিরুদ্ধাচরণ করেন।

মানিকচাঁদ-- নবাবের অন্যতম সেনাপতি। আলিবর্দির কৃপায় মুর্শিদাবাদের সেরেস্তাদারির পদে নিযুক্ত হন। মানিক চাঁদ পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাবের বিরুদ্ধাচারণ করে।

মানিকচাঁদ-- সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম সেনাপতি। ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা তাকে কলকাতার গভর্নর নিযুক্ত করেন। মানিকচাঁদ ছিলেন চরম বিশ্বাসঘাতক।

মিরমর্দা-- নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বাসী এবং দেশপ্রেমিক সেনাপতি। পলাশির যুদ্ধে তিনি অকুতোভয়ে যুদ্ধ করে সিরাজের প্রতি তার আনুগত্য প্রদর্শন করেন। যুদ্ধরত অবস্থাতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মিরজাফর-- প্রকৃত নাম মিরজাফর আলী খান। সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় পারস্য থেকে ভারতবর্ষে আসেন মিরজাফর। নবাব আলিবর্দি বৈমাত্র ভগ্নী শাহ খানমের সঙ্গে মিরজাফরের বিয়ে দিয়ে তাকে সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত করেন। যুদ্ধের সময় তিনি সর্বদা নবাবের সঙ্গে থাকবেন এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্তে¡ও নবাবের সঙ্গে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ক্লাইভের গাধা বলে পরিচিত এবং চিরকালের বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত মিরজাফর ১৭৫৭ সালে ২৯ জুন বিকেলবেলা কর্নেল ক্লাইভের হাত ধরে বাংলার মসনদে বসেন। কুষ্ঠ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে ১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান।

রাইসুল জুহালা-- ইতিহাস সিদ্ধ নারান সিংহা ( নারায়ণ সিংহ) চরিত্র সিকান্দার আবু জাফরের হাতে পড়ে হয়ে উঠেছে কৌতুক-চরিত্র রাইসুল জুহালা। রাইসুল জুহালা সাহসী, বুদ্ধিমান এবং কৌশলী, সর্বোপরি তিনি দেশপ্রেমিক। নারান সিংহ ছদ্মবেশ ধারণ করে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের খবর নবাবকে জানাতেন।

রাজবল্লভ-- বিশ্বাসঘাতক এবং অর্থলোলুপ মন্ত্রী। রাজবল্লভ ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের অধিবাসী। ঢাকায় নৌবাহিনীতে কেরানীর চাকরি করতেন। পরবর্তীকালে ‘রাজা’ উপাধি পান। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করতে রাজবল্লভ ব্যাপক  পালন করে। বাংলাদেশে ইংরেজ শক্তিকে প্রতিষ্ঠার জন্য রাজবল্লভের বিশ্বাস ঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল।

রায়দুর্লভ (দুর্লভ রাম)-- রাজা জানকীরামের পুত্র রায়দুর্লভ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে রায়দুর্লভও গভীর ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত হয়। পলাশির যুদ্ধের পর মিরন তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। অবশেষে ইংরেজদের হস্তক্ষেপে তিনি কলকাতা পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যান।

সিরাজউদ্দৌলা--বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। আলিবর্দি খাঁর প্রিয় দৌহিত্র। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে তিনি পরাজিত হন। তাঁর অধিকাংশ পারিষদই ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সিরাজ ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং সাহসী সৈনিক। নানা ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়লেও তিনি কখনো দিশাহারা হননি কিংবা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই একজন প্রজাবৎসল নবাব।

হলওয়েল-- প্রকৃত নাম জন জেফানায়া হলওয়েল। চরম মিথ্যাবাদী। কোনো ঘটনাকে বেশি করে বলা ছিল তার অভ্যাস। পেশায় তিনি ছিলেন চিকিৎসক। সিরাজের চরিত্র কলঙ্কিত করার জন্য তিনিই অন্ধক‚প হত্যা ঘটনাটি কল্পনা করে প্রচার


সারসংক্ষেপ

সরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজপক্ষ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বসে ষড়যন্ত্র করছে। ক্লেটন, জর্জ, হলওয়েল, উমিচাঁদ, মানিকচাঁদ- এরা সম্মিলিতভাবে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বসে তারা যখন সিরাজের পতনের কথা আলোচনা করছেন তখন অকস্মাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তিনি ওয়াট্স হলওয়েল প্রমুখকে ষড়যন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করতে বললেন। নবাবের সৈন্যবাহিনীর তাড়া খেয়ে কোম্পানির সৈন্যরা কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক প্রমুখ সেনাপতি দলবলসহ ভাগীরথী নদীতে ভাসমান জাহাজে আশ্রয় নেয়। চরম দুরবস্থার মধ্যে তাদের দিন কাটতে থাকে। এর মাঝেও সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্রের কোনো শেষ নেই।

এক্ষেত্রে এ-দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের কর্মকান্ড তাদের আশান্বিত করেছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্যে ঘসেটি বেগম গভীর ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত। নিজের বাড়িতে সহচরদের ডেকে তিনি ষড়যন্ত্র করছিলেন। ঘসেটি বেগমের বাড়িতে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখ। সেখানেও উপস্থিত হলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজ ঘসেটি বেগমের বাড়ির জলসা ভেঙে দিলেন। ঘসেটি বেগমকে তিনি নিজ প্রাসাদে নিয়ে যাবার হুকুম দিলেন। তার এই প্রস্তাবে ঘসেটি বেগম ক্রোধান্বিত হলেন ও সিরাজকে অভিশাপ দিতে থাকলেন।


বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

৫. কোন শাসকের মর্মন্তুদ কাহিনি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য?

ক. নবাব সিরাজের                     খ. নবাব আলিবর্দির

গ. নবাব মিরজাফরের                ঘ. লর্ড ক্লাইভের

৬. শওকত জঙ্গের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-

i. শাসনকার্যে নিতান্ত অকর্মণ্য

ii. শুধু ভাঙের গেলাস ধরে

iii. কেবল নাচনেওয়ালী বোঝে

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i             খ. ii

গ. iii           ঘ. র, ii ও iii

নিচের উদ্দীপকটি পড়–ন এবং ৭ ও ৮ নং প্রশ্নের উত্তর দিন :

পৈতৃক সম্পত্তির অংশীদারিত্ব নিয়ে দুই ভাই শ্যামল ও কাজলের মধ্যে কলহ বাঁধে। পরবর্তী সময়ে এলাকার বিশিষ্ট মুরুব্বিগণ তাদের বিবাদ মিটমাট করে দেন। পবিত্র গ্রন্থ গীতা হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে সমঝোতা হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই উভয়ের প্রতিজ্ঞা ভূলুণ্ঠিত হয়। আবার তারা কলহে মেতে উঠে।

৭. উদ্দীপকের সঙ্গে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সাদৃশ্য রয়েছে-

i. নবাবের আদেশ না মানায়

ii. মিরজাফরের পবিত্র কালাম ছুঁয়ে শপথ করায়

iii. প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করায়

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i            খ. ii

গ. iii            ঘ. ii ও iii

৮.উদ্দীপক ও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে প্রকাশিত হয়েছে-

i. ক্ষমতা ভোগ

ii. প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ 

iii. কূপমন্ডুক মানসিকতা

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i       খ. ii

গ. iii      ঘ. i ও ii 

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর

০৫. ক ০৬. ঘ ০৭. ঘ ০৮. ঘ 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনেট আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url