এইচ এস সি বাংলা ১ম পত্র মাসিপিসি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

মাসিপিসি

 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়



লেখক-পরিচিতি 

সূচীপত্র


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালের ১৯ মে ভারতের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামাতার চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। তাঁর ডাকনাম মানিক এবং পিতার দেয়া নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। তাঁর আদিনিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। পিতার সরকারি চাকরির কারণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন  স্কুলকলেজে কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা করেন। এরপর অংকশাস্ত্রে অনার্স নিয়ে স্তাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে।

এ সময়েই বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে লিখে ফেলেন প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’, যা ছাপা হয় ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায়। বিচিত্রা-য় গল্প প্রকাশের পর থেকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন সার্বক্ষণিক লেখক। ফলে উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করে বিজ্ঞানী হওয়ার বাসনা পরিত্যাগ করতে হয় তাঁকে। শেষ অবধি সার্বক্ষণিক সাহিত্যিক রূপেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমশ মাকর্সবাদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। এরই ক্রমধারায় ১৯৪৪ সালে তিনি লাভ করেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ।

 তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। তিনি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত¡ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে। সর্বমোট ৩৯টি উপন্যাস ও প্রায় তিনশো ছোটগল্প রচনা করেছেন। তাঁর পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) ও পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর অন্যতম। মনোবিশ্লেষণ, বাস্তববাদী জীবনদৃষ্টি, সাম্যবাদে আস্থা এবং মানুষের মধ্যকার সম্ভাবনার প্রতি বিশ্বাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্যের মূল প্রেরণা। ১৯৫৬ সনের ৩ ডিসেম্বর
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম 

উপন্যাস 


জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), অহিংসা (১৯৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), হরফ (১৯৫৪);

ছোটগল্প :


 প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), বৌ (১৯৪৩), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), হলুদ পোড়া
(১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), ছোট বকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০);

প্রবন্ধ :

 লেখকের কথা (১৯৫৭)। 

ভূমিকা


‘মাসিপিসি’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় (মার্চ-এপ্রিল ১৯৪৬), পরে এটি সংকলিত হয় ‘পরিস্থিতি’ (অক্টোবর ১৯৪৬) নামক গল্পগ্রন্থে। বর্তমান পাঠ গ্রহণ করা হয়েছে ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশিত মানিক রচনাবলির পঞ্চম খন্থেকে। নিঃস্ব ও বিধবা দুই নারী স্বামীর নির্যাতনের শিকার পিতৃমাতৃহীন এক তরুণীর অস্তিত্ব রক্ষায় যে সাহসী ভ‚মিকা পালন করেছে তা এই গল্পটিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের লালসা, দুর্ভিক্ষের স্মৃতি ও জীবিকা নির্বাহের কঠিন সংগ্রাম এ গল্পের বৈচিত্র্যময় দিক।

সাধারণ উদ্দেশ্য


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাসিপিসি’ গল্পটি পড়ার পর তুমি---
  • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারবে।
  • পিতৃমাতৃহীন এক তরুণীর জীবন কীভাবে স্বামীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তা জানতে পারবে।
  • সামাজিক নির্মমতা থেকে আহ্লাদিকে রক্ষার জন্য তার বিধবা ও নিঃস্ব মাসিপিসি’র বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী ভূমিকার কথা জানতে পারবে। 
  • কৈলাশ ও মাসিপিসির কথোপকথনের বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবে ।
  • আহ্লাদির নির্যাতনকারী স্বামী জগুর সংসার ছেড়ে চলে আসার কারণ বর্ণনা করতে পারবে।

 মূলপাঠ

শেষবেলায় খালে এখন পুরো ভাটা। জল নেমে গিয়ে কাদা আর ভাঙা ইটপাটকেল ও ওজনে ভারি আবর্জনা বেরিয়ে পড়েছে। কংক্রিটের পুলের কাছে খালের ধারে লাগানো সালতি থেকে খড় তোলা হচ্ছে পাড়ে। পাশাপাশি জোড়া লাগানো দুটো বড় সালতি বোঝাই আঁটিবাঁধা খড় তিনজনের মাথায় চড়ে গিয়ে জমা হচ্ছে ওপরের মস্ত গাদায়। ওঠানামার পথে ওরা খড় ফেলে নিয়েছে কাদায়। সালতি থেকে ওদের মাথায় খড় তুলে দিচ্ছে দুজন। একজনের বয়স হয়েছে, আধপাকা চুল, গোরা শরীর। অন্যজন মাঝবয়সী, বেঁটে, জোয়ান, মাথায় ঠাসা কদমছাঁটা রুক্ষ চুল।

পুলের তলা দিয়ে ভাটার টান ঠেলে এগিয়ে এল সরু লম্বা আরেকটা সালতি, দু-হাত চওড়া হয় কি না হয়। দু-মাথায় দাঁড়িয়ে দুজন প্রৌঢ়া বিধবা লগি ঠেলছে, ময়লা মোটা থানের আঁচল দুজনেরই কোমরে বাঁধা। মাঝখানে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে অল্পবয়সী একটি বৌ। গায়ে জামা আছে, নকশা পাড়ের সস্তা সাদা শাড়ি। আঁটসাঁট থমথমে গড়ন, গোলগাল মুখ। মাসিপিসি ফিরছে কৈলেশ’, বুড়ো লোকটি বলল।
কৈলাশ বাহকের মাথায় খড় চাপাতে ব্যস্ত ছিল। চটপট শেষ আঁটিটা চাপিয়ে দিয়ে সে যখন ফিরল, মাসিপিসির সালতি দুহাতের মধ্যে এসে গেছে।

“ও মাসি, ওগো পিসি, রাখো রাখো। খপর আছে শুনে যাও।” সামনের দিকে লগি পুঁতে মাসিপিসি সালতির গতি ঠেকায়, আহ্লাদি সিঁথির সিঁদুর পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দেয়। সামনে থেকে মাসি বলে বিরক্তির সঙ্গে, ‘বেলা আর নেই কৈলেশ।’ পেছনে থেকে পিসি বলে, ‘অনেকটা পথ যেতে হবে কৈলেশ’।
মাসিপিসির গলা ঝরঝরে, আওয়াজ একটু মোটা, একটু ঝংকার আছে। কৈলাশের খবরটা গোপন, দুজনে লম্বা লম্বা সালতির দু-মাথায় থাকলে সম্ভব নয় চুপে চুপে বলা। মাসি বড় সালতির খড় ঠেকানো বাঁশটা চেপে ধরে থাকে, পিসি লগি হাতে নিয়েই পিছন থেকে এগিয়ে আসে সামনের দিকে। আহ্লাদি যেখানে ছিল সেখানে বসেই কান পেতে রাখে।

 কথাবার্তা সে সব শুনতে পায় সহজেই। কারণ, সে যাতে শুনতে পায় এমনি করেই বলে কৈলাশ।
‘বলি মাসি, তোমাকেও বলি পিসি’, কৈলাশ শুরু করে, ‘মেয়াকে একদম শ্বশুরঘর পাঠাবে না মনে করেছ যদি, সে কেমন ধারা কথা হয়? এত বড় সোমত্ত মেয়া, তোমরা দুটি মেয়েলোক বাদে ঘরে একটা পুরুষমানুষ নেই, বিপদ-আপদ ঘটে যদি তো- মাসি বলে, ‘খুনসুটি রাখো দিকি কৈলেশ তোমার, মোদ্দাকথাটা কী তাই কও, বললে না যে খপর আছে কী?’ পিসি বলে, ‘খপরটা কী তাই কও। বেলা বেশি নেই কৈলেশ।’

মাসিপিসির সাথে পারা যাবে না জানে কৈলাশ। অগত্যা ফেনিয়ে রসিয়ে বলবার বদলে সে সোজা কথায় আসে, ‘জগুর সাথে দেখা হলো কাল। খড় তুলে দিতে সাঁঝ হয়ে গেল, তা দোকানে এটটু-মানে আর কি চা খেতে গেছি চায়ের দোকানে, জগুর সাথে দেখা।’
মাসি বলে, ‘চায়ের দোকান না কিসের দোকান তা বুঝিছি কৈলেশ, তা কথাটা কী?’
পিসি বলে, ‘সেথা ছাড়া আর ওকে কোথা দেখবে। হাতে দুটো পয়সা এলে তোমারও স্বভাব বিগড়ে যায় কৈলেশ। তা, কী বললে জগু?
কৈলাশ ফাঁপরে পড়ে আড়চোখে চায় আহ্লাদির দিকে, হঠাৎ বেমক্কা জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করে যে, তা নয়, পুলের কাছেই চায়ের দোকান, মাসিপিসি গিয়ে জিজ্ঞাসা করুক না সেখানে। তারপরেই জোর হারিয়ে বলে ‘ওসব একরকম ছেড়ে দিয়েছে জন্ড। লোকটা কেমন বদলে গেছে মাসি, সত্যি কথা পিসি, জন্ড আর সেই জন্ড নেই। বউকে নিতে চায় এখন। তোমরা নাকি পণ করেছ মেয়া পাঠাবে না, তাতেই চটে আছে। সম্মান তো আছে একটা মানুষের, কবার নিতে এল তা মেয়া দিলে না, তাই তো নিতে আসে না আর। আমি বলি কী, নিজেরা যেচে এবার পাঠিয়ে দেও মেয়াকে।’

মাসি বলে, ‘পেটে শুকিয়ে লাথি ঝাঁটা খেতে? কলকেপোড়া ছ্যাঁকা খেতে? খুঁটির সাথে দড়িবাঁধা হয়ে থাকতে দিনভর রাতভর?’ পিসি-বলে, ‘মেয়া না পাঠাই, জামাই এলে রাখিনি জামাই-আদরে তাকে? ছাগলটা বেচে দিয়ে খাওয়াইনি ভালোমন্দ দশটা জিনিস?’ মাসি বলে, ‘ফের আসুক, আদরে রাখব যদ্দিন থাকে। বজ্জাত হোক, খুনে হোক, জামাই তো। ঘরে এলে খাতির না করব কেন? তবে মেয়া মোরা পাঠাব না।’ পিসি বলে, ‘নে কৈলেশ, মরতে মোরা মেয়াকে পাঠাব না।’ বুড়ো রহমান একা খড় চাপিয়ে যায় বাহকদের মাথায়, চুপচাপ শুনে যায় এদের কথা। ছলছল চোখে একবার তাকায়
আহ্লাদির দিকে। তার মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে মরেছে অল্পদিন আগে।

 কিছুতে যেতে চায়নি মেয়েটা, দাপাদাপি করে কেঁদেছে যাওয়া ঠেকাতে, ছোট অবুঝ মেয়ে। তার ভালোর জন্যেই তাকে জোর-জবরদস্তি করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আহ্লাদির সঙ্গে তার চেহারায় কোনো মিল নাই। বয়সে সে ছিল অনেক ছোট, চেহারা ছিল অনেক বেশি রোগা। তবু আহ্লাদির ফ্যাকাশে মুখে তারই মুখের চাপ রহমান দেখতে পায়, খড়ের আঁটি তুলে দেবার ফাঁকে ফাঁকে যখনই সে তাকায় আহ্লাদির দিকে।
কৈলাশ বলে, ‘তবে আসল কথাটা বলি। জগু মোকে বললে, এবার সে মামলা করবে বৌ নেবার জন্য। তার বিয়ে করা বৌকে তোমরা আটকে রেখেছ বদ মতলবে। মামলা করলে বিপদে পড়বে।

সোয়ামি নিতে চাইলে বৌকে আটকে রাখার আইন নেই। জেল হয়ে যাবে তোমাদের। আর যেমন বুঝলাম, মামলা জগু করবেই আজকালের মধ্যে। মরবে তোমরা জান মাসি, জান পিসি, মারা পড়বে তোমরা একেবারে। আহ্লাদি একটা শব্দ করে, অস্ফুট আর্তনাদের মতো। মাসি ও পিসি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে কয়েক বার। মনে হয়, মনে তাদের একই কথা উদয় হয়েছে, চোখে চোখে চেয়ে সেটা শুধু জানাজানি করে নিল তারা। মাসি বলল, ‘জেলে নয় গেলাম কৈলেশ, কিন্তু মেয়া যদি সোয়ামির কাছে না যেতে চায় খুন হবার ভয়ে?’

বলে মাসি বড় সালতির খড় ঠেকানো বাঁশ ছেড়ে দিয়ে লগি গুঁজে দেয় কাদায়, পিসি তরতর করে পিছনে গিয়ে লগি কাদায় গুঁজে হেলে পড়ে, শরীরের ভারে সরু লম্বা সালতিটাকে এগিয়ে দেয় ভাটার টানের বিপক্ষে। বেলা একরকম নেই। ছায়া নামছে চারদিকে। শকুনরা উড়ে এসে বসছে পাতাশূন্য শুকনো গাছটায়। একটা শকুন উড়ে গেল এ আশ্রয় ছেড়ে অল্প দূরে আরেকটা গাছের দিকে। ডাল ছেড়ে উড়তে আর নতুন ডালে গিয়ে বসতে কী তার পাখা ঝাপটানি! মায়ের বোন মাসি আর বাপের বোন পিসি ছাড়া বাপের ঘরের কেউ নেই আহ্লাদির। দুর্ভিক্ষ কোনোমতে ঠেকিয়েছিল তার বাপ। মহামারীর একটা রোগে, কলেরায়, সে, তার বৌ আর ছেলেটা শেষ হয়ে গেল।

মাসিপিসি তার আশ্রয়ে মাথা গুঁজে আছে অনেক দিন, দূর ছাই সয়ে আর কুড়িয়ে পেতে খেয়ে নিরাশ্রয়
বিধবারা যেমন থাকে। নিজেদের ভরণপোষণের কিছুটা তারা রোজগার করত ধান ভেনে, কাঁথা সেলাই করে, ডালের বড়ি বেচে, হোগলা গেঁথে, শাকপাতা ফলমূল ডাঁটা কুড়িয়ে, এটা ওটা জোগাড় করে। শাকপাতা খুদকুঁড়ো ভোজন, বছরে দুজোড়া থান পরন-খরচ তো এই। বছরের পর বছর ধরে কিছু পুঁজি পর্যন্ত হয়েছিল দুজনের, রূপোর টাকা আধুলি সিকি।

দুর্ভিক্ষের সময়টা বাঁচবার জন্য তাদের লড়তে হয়েছে সাংঘাতিকভাবে, আহ্লাদির বাপ তাদের থাকাটা শুধু বরাদ্দ রেখে খাওয়া ছাঁটাই করে দিয়েছিল একেবারে পুরোপুরি। তারও তখন বিষম অবস্থা। নিজেরা বাঁচে না, তার ওপর জগুর লাথির চোটে মরমর মেয়ে এসে হাজির। সে কোনদিক সামলাবে? মাসিপিসির সেবা-যতেই আহ্লাদি অবশ্য সেবার বেঁচে গিয়েছিল, তার বাপ-মাও সেটা স্বীকার করেছে। কিন্তু কী করবে, গলা কেটে রক্ত দিয়ে সে ধার শোধ করা যদি-বা সম্ভব, অন্ন দেওয়ার ক্ষমতা কোথায় পাবে।

পাল্লা দিয়ে মাসিপিসি আহ্লাদির জীবনের জন্য লড়েছিল, পেল যদি তো খেয়ে না-পেল যদি তো
না-খেয়েই। অবস্থা যখন তাদের অতি কাহিল, চারদিকে না-খেয়ে মরা শুরু করেছে মানুষ, মরণ ঠেকাতেই ফুরিয়ে আসছে তাদের জীবনীশক্তি; একদিন মাসি বলে পিসিকে, ‘একটা কাজ করবি বেয়াইন? তাতে তোরও দুটো পয়সা আসে, মোরও দুটো পয়সা আসে।’ শহরের বাজারে তরিতরকারি ফলমূলের দাম চড়া। গাঁ থেকে কিনে যদি বাজারে গিয়ে বেচে আসে তারা, কিছু রোজগার হবে। একা মাসির ভরসা হয় না সালতি বেয়ে অতদূর যেতে, যাওয়া-আসাও একার দ্বারা হবে না তার।

পিসি রাজি হয়েছিল। এতে কিছু হবে কি না হবে ভগবান জানে, কিন্তু যদি হয় তবে রোজগারের একটা নতুন উপায় মাসি পেয়ে যাবে আর সে পাবে না, তাকে না পেলে অন্য কারো সাথে হয়ত মাসি বন্দোবস্ত করবে, তা কি পারে পিসি ঘটতে দিতে। সেই থেকে শুরু হয় গেরস্তের বাড়তি শাকসবজি ফলমূল নিয়ে মাসিপিসির সালতি বেয়ে শহরের বাজারে গিয়ে বেচে আসা। গাঁয়ের বাবু বাসিন্দারাও নগদ পয়সার জন্য বাগানের জিনিস বেচতে দেয়। মাসিপিসির ভাব ছিল আগেও।

 অবস্থা এক, বয়স সমান, একঘরে বাস, পরস্পরের কাছে ছাড়া সুখ-দুঃখের কথা তারা কাকেই-বা বলবে, কেই-বা শুনবে। তবে হিংসা দ্বেষ রেষারেষিও ছিল যথেষ্ট, কোন্দলও বেধে যেত কারণে অকারণে। পিসি
এ বাড়ির মেয়ে, এ তার বাপের বাড়ি। মাসি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এখানে। তাই মাসির উপর পিসির একটা অবজ্ঞা অবহেলার ভাব ছিল। এই নিয়ে পিসির অহংকার আর খোঁচাই সবচেয়ে অসহ্য লাগত মাসির। ধীর শান্ত দুঃখী মানুষ মনে হতো এমনি তাদের, কিন্তু ঝগড়া বাধলে অবাক হয়ে যেতে হতো তাদের দেখে। সে কী রাগ, সে কী তেজ, সে কী গোঁ!

মনে হতো এই বুঝি কামড়ে দেয় একে অপরকে, এই বুঝি কাটে বঁটি দিয়ে। শাকসবজি বেচে বাঁচবার চেষ্টায় একসঙ্গে কোমর বেঁধে নেমে পড়ামাত্র সব বিরোধ সব পার্থক্য উড়ে গিয়ে দুজনের হয়ে গেল একমন, একপ্রাণ। সে মিল জমজমাট হয়ে উঠল আহ্লাদির ভার ঘাড়ে পড়ায়। নিজের পেট ভরানো শুধু নয়, নিজেদের বেঁচে থাকা শুধু নয়, তাদের দুজনেরই এখন আহ্লাদি আছে। খাইয়ে পরিয়ে যতেœ রাখতে হবে তাকে, শ্বশুরঘরের কবল থেকে বাঁচাতে হবে তাকে, গাঁয়ের বজ্জাতদের নজর থেকে সামলে রাখতে হবে, কত দায়িত্ব তাদের, কত কাজ, কত ভাবনা।

বাপ মা বেঁচে থাকলে আহ্লাদিকে হয়ত শ্বশুরবাড়ি যেতে হতো, মাসিপিসিও বিশেষ কিছু বলতো কি না সন্দেহ। কিন্তু তারা তো নেই, এখন মাসিপিসিরই সব দায়িত্ব। বিনা পরামর্শে আপনা থেকেই তাদের ঠিক হয়েছিল, আহ্লাদিকে পাঠানো হবে না। আহ্লাদিকে কোথাও পাঠানোর কথা তারা ভাবতেও পারে না। বিশেষ করে ওই খুনেদের কাছে কখনো মেয়ে তারা পাঠাতে পারে, যাবার কথা ভাবলেই মেয়ে যখন আতঙ্কে পাঁশুটে মেরে যায়? বাপের ঘরদুয়ার জমিজমাটুকু আহ্লাদিকে বর্তেছে, জগুর বৌ নেবার আগ্রহও খুবই স্পষ্ট।

 সামান্যই ছিল তার বাপের, তারও সিকিমতো আছে মোটে, বাকি গেছে গোকুলের কবলে। তবু মুফতে যা পাওয়া যায় তাতেই জগুর প্রবল লোভ। খালি ঘরে আহ্লাদিকে রেখে কোথাও যাবার সাহস তাদের হয় না। দুজনের মিলে যদি যেতে হয় কোথাও আহ্লাদিকে তারা সঙ্গে নিয়ে যায়। মাসি বলে, ‘ডরাস্নি আহ্লাদি। ভাঁওতা দিয়ে আমাদের দমাবার ফিকির সব। নয় তো কৈলেশকে দিয়ে ওসব কথা বলায় মোদের?’
পিসি বলে, ‘দুদিন বাদে ফের আসবে দেখিস জামাই। তখন শুধোলে বলবে, কই না, আমি তো ওসব কিছু বলি নি কৈলেশকে।’

মাসি বলে, ‘চার মাসে পড়লি, আর কটা দিন বা। মা-মাসির কাছেই রইতে হয় এ সময়টা, জামাই এলে বুঝিয়ে বলব।’ পিসি বলে, ‘ছেলে মুখ দেখে পাষাণ নরম হয়, জানিস আহ্লাদি। তোর পিসে ছিল জগুর মতো। খোকাটা কোলে আসতে কী হয়ে গেল সেই মানুষ। চুপি চুপি এসে এটা ওটা খাওয়ায়, উঠতে বলি তো ওঠে, বসতে বলি তো বসে। মাসি বলে, ‘তোর মেসো ঠিক ছিল, শাউড়ি ননদ ছিল বাঘ। উঠতে বসতে কী ছ্যাঁচা খেয়েছি ভাবলে বুক কাঁপে। কিন্তু জানিস আহ্লাদি, মেয়েটা যেই কোলে এল শাউড়ি ননদ যেন মোকে মাথায় করে রাখলে বাঁচে।’

পিসি বলে, ‘তুইও যাবি, সোয়ামির ঘর করবি। ডরাস্নি, ডরকিসের?’ বাড়ি ফিরে দীপ জ্বেলে মাসিপিসি রান্নাবান্না সারতে লেগে যায়। বাইরে দিন কাটলেও আহ্লাদির পরিশ্রম কিছু হয়নি, শুয়ে বসেই দিন কেটেছে। তবু মাসিপিসির কথায় সে একটু শোয়। শরীর নয়, মনটা তার কেমন করছে। নিজেকে তার ছ্যাঁচড়া, নোংরা, নর্দমার মতো লাগে। মাসিপিসির আড়ালে থেকেও সে টের পায় কীভাবে মানুষের পর মানুষ তাকাচ্ছে তার দিকে, কতজন কতভাবে মাসিপিসির সঙ্গে আলাপ জমাচ্ছে তরিতরকারির মতো তাকেও কেনা যায় কি না যাচাই করবার জন্য।

গাঁয়েরও কতজন তার কত রকমের দর দিয়েছে মাসিপিসির কাছে। মাসিপিসিকে চিনে তারা অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে আজকাল, কিন্তু গোকুল হাল ছাড়েনি। মাসিপিসিকে পাগল করে তুলেছে গোকুল। মায়ের বাড়া তার এই মাসিপিসি, কী দুর্ভোগ তাদের তার জন্য। মাসিপিসিকে এত যন্ত্রণা দেওয়ার চেয়ে সে নয় শ্বশুরঘরের লাঞ্ছনা সইত, জগুর লাথি খেত। ঈষৎ তন্দ্রার ঘোরে শিউরে ওঠে আহ্লাদি। একপাশে মাসি আর একপাশে পিসিকে না নিয়ে শুলে কি চলবে তার কোনোদিন?

রান্না সেরে খাওয়ার আয়োজন করছে মাসিপিসি, একেবারে ভাতটাত বেড়ে আহ্লাদিকে ডাকবে। ভাগাভাগি কাজ তাদের এমন সহজ হয়ে গেছে যে বলাবলির দরকার তাদের হয় না, দুজনে মিলে কাজ করে যেন একজনে করছে। এবার ব্যঞ্জনে নুন দেবে এ কথা বলতে হয় না পিসিকে, ঠিক সময়ে নুনের পাত্র সে এগিয়ে দেয় মাসির কাছে। বলাবলি করছে তারা আহ্লাদির কথা, আহ্লাদির সুখদুঃখ, আহ্লাদির সমস্যা আহ্লাদির ভবিষ্যৎ।

 জমাই যদি আসে, একটি কড়া কথা তাকে বলা হবে না, এতটুকু খোঁচা দেওয়া হবে না। উপদেশ দিতে গেলে চটবে জামাই, পুরুষমানুষ তো যতই হোক, এটা করা তার উচিত নয়, এসব কিছু বলা হবে না তাকে। জামাই এসেছে তাই আনন্দ রাখবার যেন ঠাঁই নেই এই ভাব দেখাবে মাসিপিসি- আহ্লাদিকে শিখিয়ে দিতে হবে সোয়ামি এসেছে বলে যেন আহ্লাদে গদগদ হবার ভাব দেখায়। যে কদিন থাকে জামাই, সে যেন অনুভব করে, সে-ই এখানকার কর্তা, সে-ই সর্বেসর্বা।

বাইরে থেকে হাঁক আসে কানাই চৌকিদারের। মাসিপিসি পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়, জোরে নিঃশ্বাস পড়ে দুজনের। সারাটা দিন গেছে লড়ে আর লড়ে। সরকারবাবুর সঙ্গে বাজারের তেলা নিয়ে ঝগড়া করতে অর্ধেক জীবন বেরিয়ে গেছে দুজনের। এখন এল চৌকিদার কানাই। হাঙ্গামা না আসে রাত্রে, গাঁয়ে লোক যখন ঘুমোচ্ছে।


রসুই চালায় ঝাঁপ এঁটে মাসিপিসি বাইরে যায়। শুক্লপক্ষের একাদশীর উপোস করেছে তারা দুজনে গতকাল। আজ দ্বাদশী, জ্যোৎ জ্যোডা বেশ উজ্জ্বল। কানাইয়ের সাথে গোকুলের যে তিনজন পেয়াদা এসেছে তাদের মাসিপিসি চিনতে পারে, মাথায় লাল পাগড়ি-আঁটা লোকটা তাদের অচেনা।
কানাই বলে, ‘কাছারিবাড়ি যেতে হবে একবার।’
মাসি বলে, ‘এত রাতে?’
পিসি বলে, ‘মরণ নেই?’
কানাই বলে, ‘দারোগাবাবু এসে বসে আছেন বাবুর সাথে। যেতে একবার হবেগো দিদিঠাকরুনরা। বেঁধে নিয়ে যাবার হুকুম আছে।’ মাসিপিসি মুখে মুখে তাকায়। পথের পাশে ডোবার ধারে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় তিন-চারজন ঘুপটি মেরে আছে স্পষ্টই দেখতে পেয়েছে মাসিপিসি। ওরা যে গাঁয়ের গুন্ডা সাধু বৈদ্য ওসমানেরা তাতে সন্দেহ নেই, বৈদ্যের ফেটি-বাঁধা বাবরি চুলওয়ালা মাথাটায় পাতার ফাঁকে জ্যোডা পড়েছে। তারা যাবে কাছারিতে কানাই আর পেয়াদা কনস্টেবলের সঙ্গে। ওরা এসে আহ্লাদিকে নিয়ে যাবে।

মাসি বলে, ‘মোদের একজন গেলে হবে না কানাই?’
পিসি বলে, ‘আমি যাই বলো?’
কর্তা ডেকেছেন দুজনকে।
মাসিপিসি দুজনেই আবার তাকায় মুখে মুখে।
মাসি বলে, ‘কাপড়টা ছেড়ে আসি কানাই।’
পিসি বলে, ‘হাত ধুয়ে আসি, একদন্ড লাগবে না।’
তাড়াতাড়িই ফিরে আসে তারা। মাসি নিয়ে আসে বঁটিটা হাতে করে, পিসির হাতে দেখা যায় রামদার মতো মস্ত একটা কাটারি।
মাসি বলে, ‘কানাই, কত্তাকে বোলো, মেয়েনোকের এত রাতে কাছারিবাড়ি যেতে লজ্জা করে। কাল সকালে যাব।’

পিসি বলে, ‘এত রাতে মেয়েনোককে কাছারিবাড়ি ডাকতে কত্তার নজ্জা করে না কানাই?’
কানাই ফুঁসে ওঠে, ‘না যদি যাও ঠাকরুনরা ভালোয় ভালো, ধরে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার হুকুম আছে কিন্তু বলে রাখলাম।’ মাসি বঁটিটা বাগিয়ে ধরে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে, ‘বটে? ধরে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার হুকুম আছে কিন্তু বলে রাখলাম।’
মাসি বঁটিটা বাগিয়ে ধরে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে, ‘বটে? ধরে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে? এসো। কে এগিয়ে আসবে এসো। বাঁটির এক কোপে গলা ফাঁক করে দেব।’
পিসি বলে, ‘আয় না বজ্জাত হারামজাদারা, এগিয়ে আয় না? কাটারির কোপে গলা কাটি দু-একটার।’
দু-পা এগোয় তারা দ্বিধাভরে। মাসিপিসির মধ্যে ভয়ের লেশটুকু না দেখে সত্যিই তারা খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। মারাত্মক ভঙ্গিতে বঁটি আর দা উঁচু হয় মাসিপিসির।

মাসি বলে, ‘শোনো কানাই, এ কিন্তু এর্কি নয় মোটে। তোমাদের সাথে মোরা মেয়েনোক পারব না জানি কিন্তু দুটোএকটাকে মারব জখম করব ঠিক।’
পিসি বলে, ‘মোরা নয় মরব।’
তারপর বিনা পরামর্শেই মাসিপিসি হঠাৎ গলা ছেড়ে দেয়। প্রথমে শুরু করে মাসি, তারপর যোগ দেয় পিসি। আশপাশে যত
বাসিন্দা আছে সকলের নাম ধরে গলা ফাটিয়ে তারা হাঁক দেয়, ও বাবাঠাকুর! ও ঘোষ মশায়! ও জনাদ্দন! ওগো কানুর মা!,
বিপিন!, বংশী ...,

কানাই অদৃশ্য হয়ে যায় দলবল নিয়ে। হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায় পাড়ায়, অনেকে ছুটে আসে, কেউ কেউ ব্যাপার অনুমান করে ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দেয় বাইরে না বেরিয়ে। এই হট্টগোলের পর আরও নিঝুম আরও থমথমে মনে হয় রাত্রিটা। আহ্লাদিকে মাঝখানে নিয়ে শুয়ে ঘুম আসে না মাসিপিসির চোখে। বিপদে পড়ে হাঁক দিলে পাড়ার এত লোক ছুটে আসে, এমনভাবে প্রাণ খুলে এতখানি জ্বালার সঙ্গে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলিভাবে গোকুল আর দারোগা ব্যাটার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে সাহস পায়, জানা ছিল না মাসিপিসির।

 তারা হাঁকডাক শুরু করেছিল খানিকটা কানাইদের ভড়কে দেবার জন্যে, এত লোক এসে পড়বে আশা করেনি। তাদের জন্য যতটা নয়, গোকুল আর দারোগার ওপর রাগের জ্বালাই যেন ওদের ঘর থেকে টেনে বার করে এনেছে মনে হলো সকলের কথাবার্তা শুনে। কেমন একটা স্বস্তি বোধ করে মাসিপিসি। বুকে নতুন জোর পায়।
মাসি বলে, ‘জানো বেয়াইন, ওরা ফের ঘুরে আসবে মন বলছে। এত সহজে ছাড়বে কি।’
পিসি বলে, ‘তাই ভাবছিলাম। মেয়েটাকে কুটুমবাড়ি সরিয়ে দেওয়ায় সোনাদের ঘরে মাঝরাতে আগুন ধরিয়েছিল সেবার।’
খানিক চুপচাপ ভাবে দুজনে।
মাসি বলে, ‘সজাগ রইতে হবে রাতটা।’
পিসি বলে, ‘তাই ভালো। কাঁথা কম্বলটা চুবিয়ে রাখি জলে, কী জানি কী হয়।’
আস্তে চুপি চুপি তারা কথা কয়, আহ্লাদির ঘুম না ভাঙে। অতি সন্তর্পণে তারা বিছানা ছেড়ে ওঠে। আহ্লাদির বাপের আমলের গোরুটা নেই, গামলাটা আছে। ঘড়া থেকে জল ঢেলে মোটা কাঁথা আর পুরনো ছেঁড়া একটা কম্বল চুবিয়ে রাখে, চালায় আগুন ধরে উঠতে উঠতে গোড়ায় চাপা দিয়ে নেভানো যাতে সহজ হয়। ঘড়ায় আর হাঁড়ি কলসিতে আরও জল এনে রাখে তারা ডোবা থেকে। বঁটি আর দা রাখে হাতের কাছেই। যুদ্ধের আয়োজন করে তৈরি হয়ে থাকে মাসিপিসি।

শব্দের অর্থ 


কলকেপোড়া ছ্যাঁকা- তামাকসেবনে ব্যবহৃত হুকার উপরে কলকেতে থাকে যে আগুন তা দিয়ে দগ্ধ                                          করা।
  কদমছাঁট-মাথার চুল এমনভাবে ছাঁটা যে তা কদমফুলের আকার ধারণ করে। 

খপর- ‘খবর’ শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ। 
খুনসুটি- হাসিতামাশাযুক্ত  বিবাদ বা ঝগড়া। 
পেটে শুকিয়ে লাথি ঝাঁটা- পর্যাপ্ত খাবার না জুগিয়ে কষ্ট দেওয়ার পাশাপাশি লাথি ঝাঁটার
                                               মাধ্যমে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা।
 বেমক্কা- স্থান-বহিভর্‚ত, অসংগত। 
মেয়া- ‘মেয়ে’ শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ। 
লগি-হাত ছয়েক লম্বা সরু বাঁশ। নৌকা চালানোর জন্য ব্যবহৃত বাঁশের দন্ড 
সালতি-  শালকাঠ নির্মিত বা তালকাঠের সরু ডোঙা।
 সোমত্ত- সমর্থ (সংসারধর্ম পালনে), যৌবনপ্রাপ্ত
এর্কি- ‘ইয়ার্কি’ শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ, হাস্য-পরিহাস বা রসিকতা।  
কাটারি- কাটবার অস্ত্র। 
ডালের বড়ি- চালকুমড়া ও কলাইয়ের ডাল পিষে ছোট ছোট আকারে তৈরি করা খাদ্যবস্তু যা রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয় এবং সবজি-মাছ-মাংসের
সঙ্গে রান্না করে খাওয়া হয়। 
পাঁশুটে- ছাইবর্ণবিশিষ্ট, পাংশুবর্ণ, পান্ডুর, ফ্যাকাশে। 
বাজারের তোলা - বাজারে বিক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করা খাজনা। 
ব্যঞ্জন-রান্না-করা তরকারি । 
 সড়গড়- রপ্ত, মুখস্থ, অভ্যস্ত, স্মৃতিগত।

সৃজনশীল প্রশ্ন-১ 


স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে হাসু ও মায়মুনাকে নিয়ে অথৈ পাথারে ভেসে চলছিল জয়গুন। একসময় সমাজ ও লোকলজ্জা বিসর্জন দিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজে। এভাবে জয়গুন অকূল পাথারে কূল খুঁজে পায়। কেননা তাকে নিজে বাঁচতে হবে। ছেলেমেয়েদেরকে বাঁচাতে হবে। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এমনও হতে পারে তার এই জীবনসংগ্রাম অনেককাল ধরে চলবে।

ক. ‘ছেলের মুখ দেখে পাষাণ নরম হয়’ -উক্তিটি কার?
খ. মাসিপিসি কীভাবে কানাইকে প্রতিহত করেছিল?
গ. উদ্দীপকের জয়গুন ‘মাসিপিসি’ গল্পে কোন চরিত্রের সঙ্গে কীভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ?
ঘ. উদ্দীপকে জীবন সংগ্রামের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ‘মাসিপিসি’ গল্পের আলোকে বিশ্লেষণ করুন। 

 সৃজনশীল প্রশ্ন-১ উত্তর 


ক.

‘ছেলের মুখ দেখে পাষাণ নরম হয়’ -উক্তিটি পিসি করেছিল।
খ.

মাসিপিসি বঁটি ও কাটারি হাতে প্রতিবেশীদের ডেকে এনে কানাইকে প্রতিহত করেছিল।
কানাই বেশ রাত করে মাসিপিসিকে কাছারিতে ডেকে নিতে আসে। এতে তাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তাছাড়া মাসিপিসি ঝোঁপের আড়ালে লুকানো সাধু বৈদ্য ও ওসমানকে দেখে ফেলে। তাই তারা ঘরে গিয়ে বঁটি আর কাটারি নিয়ে আসে। তারপর প্রতিবেশিদের জোরে জোরে ডাকতে থাকে। প্রতিবেশীরা ছুটে এলে অবস্থা বেগতিক দেখে কানাই তার দলবল নিয়ে পালিয়ে যায়। বস্তুত মাসিপিসির অদম্য সাহস আর আহ্লাদির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই কানাইকে প্রতিহত করতে মাসিপিসিকে অনুপ্রেরণা যোগায়। 

গ.

উদ্দীপকের জয়গুনের সঙ্গে ‘মাসিপিসি’ গল্পের মাসিপিসির সাদৃশ্য রয়েছে। পৃথিবীতে মানুষকে নিজের অস্তিত্ব নিজেই টিকিয়ে রাখতে হয়। এটা করতে গিয়ে সে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবুও মানুষ চলার পথে সমস্ত দ্বিধা-দ্ব›দ্ব, সংস্কার, বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যায়।

উদ্দীপকে জয়গুন নামের এক অসহায় নারীর পরিচয় পাওয়া যায়। স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে সে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। অন্যদিকে ‘মাসিপিসি’ গল্পেও দেখা যায়, আহ্লাদির পিতা মারা যাওয়ায় মাসিপিসি অস্তিত্বের সংকটে উপনীত হয়। জয়গুন ও মাসিপিসির জীবনের সংকট তাদেরকে এক কাতারে এনে দাঁড় করায়। তারা পতিত হয় সমাজের পঙ্কিল ঘূর্ণাবর্তে। গল্পে মাসিপিসি যেমন আহ্লাদিকে আগলে রাখে তেমনি জয়গুনও তার দুই সন্তান হাসু ও মায়মুনাকে সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে। এভাবে উদ্দীপকের জয়গুনের সঙ্গে ‘মাসিপিসি’ গল্পেমাসিপিসির সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। 

ঘ.


উদ্দীপকে জয়গুনের জীবনসংগ্রামের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ‘মাসিপিসি’ গল্পে মাসিপিসির জীবনসংগ্রামকে প্রতিফলিত করে। মানুষকে জীবনে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। অন্যথায় সে বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যায়। জীবন কখনো অলসদের পক্ষ অবলম্বন করে না। সক্ষমতার শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই করে মানুষকে জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে হয়।

উদ্দীপকে জয়গুনের জীবনসংগ্রামের চিত্র বর্ণিত হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তাকে জীবনসংগ্রামে নামতে হয়। সে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জয়গুন জীবন যুদ্ধে নিজে বাঁচতে চায় এবং নিজের সন্তান হাসু ও মায়মুনাকে আগলে রাখে। এই যুদ্ধে সে জয়ী হয়। এভাবে একই চিত্র ফুটে উঠেছে ‘মাসিপিসি’ গল্পের মাসিপিসির জীবনচিত্রে। মাসিপিসি গ্রাম থেকে নানা রকম পণ্য সংগ্রহ করে শহরে বিক্রি করে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার পাশাপাশি তারা তাদের সন্তানতুল্য আহ্লাদিকেও সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে।

উদ্দীপকে জয়গুন স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে জীবন যুদ্ধে নেমেছে। আর নিজ সন্তান হাসু ও মায়মুনাকে সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে আগলে রেখেছে। ঠিক তেমনি দুর্ভিক্ষের কারণে মাসিপিসিও সমাজের সকল বিধিনিষেধ ও সংস্কার উপেক্ষা করে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে। এভাবে দেখা যায়, উদ্দীপকের জয়গুনের জীবন সংগ্রাম ‘মাসিপিসি’ গল্পেমাসিপিসির জীবন সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে। 


নিজে কর


সৃজনশীল প্রশ্ন ১

মা তাকে জেরা করলেন। দেখলাম সে ভারি চাপা। মার প্রশ্নের ছাঁকা জবাব দিল, নিজে থেকে একটি কথা বেশি কইল না। সে বলল, তার নাম মমতা। আমাদের বাড়ি থেকে খানিক দূরে জীবনময়ের গলি, গলির ভেতরে সাতাশ নম্বর বাড়ির একতলায় সে থাকে। তার স্বামী আছে আর একটি ছেলে। স্বামীর চাকরি নেই চারমাস, সংসার আর চলে না, সে তাই পর্দা ঠেলে উপার্জনের জন্য বাইরে এসেছে। এই তার প্রথম চাকরি। মাইনে ? সে তা জানে না। দুবেলা রেঁধে দিয়ে যাবে কিন্তু খাবে না।

ক. কোথায় ফলমূলের দাম চড়া?
খ. মাসিপিসি কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করে?
গ. মাসিপিসির কোন কোন বৈশিষ্ট্য উদ্দীপকের মমতা চরিত্রটিতে ফুটে উঠেছে? -আলোচনা করুন।
ঘ. উদ্দীপকটি ‘মাসিপিসি’ গল্পের সমগ্র ভাব ধারণ করে কি? -আপনার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধর।

সৃজনশীল প্রশ্ন-২ 

“হে, বেবাক মাইনষেরেই এমবায় ঠকাইছে।” করিম গাজী বলে, “আরে মিয়া এমুন কারবারডা অইল আর তুমি ফির‌্যা চলছো?” “কী করমু তয়?” বলে ওসমান। “কী করবা।” খেঁকিয়ে ওঠে করিম গাজী, “চল আমাগ লগে, দেখি কী করতে পারি।” করিম গাজী তাড়া দেয়, “কী মিয়া চাইয়া রইছ ক্যান? আরে এমনেও মরছি অমনেও মরছি। একটা কিছু না কইর‌্যা ছাইড়্যা দিমু?” ওসমান তোতাকে ঠেলে দিয়ে বলে, “তুই বাড়ী যা গা।” তার ঝিমিয়ে পড়া রক্ত জেগে ওঠে। গা ঝাড়া দিয়ে সে বলে- “হ, চল। রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।”

ক. শকুনরা উড়ে এসে কোথায় বসেছে?
খ. আহ্লাদি কেন স্বামীর ঘরে যেতে চায় না?
গ. উদ্দীপকের কোন দিকটি ‘মাসিপিসি’ গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? -আলোচনা করুন।
ঘ. “মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসেই অন্যায় প্রতিহত হয়।” -উদ্দীপক ও ‘মাসিপিসি’ গল্প অনুসরণে মন্তব্যটি বিচার কর। 

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন 


১. আহ্লাদির স্বামীর নাম কী?
ক. জগু খ. কৈলাশ
গ. কানাই ঘ. গোকুল

২. ‘বজ্জাত হোক, খুনে হোক, জামাই তো।’ Ñবলতে কী বোঝানো হয়েছে?
ক. মেয়ের প্রতি ভালবাসা খ. মেয়ে জামাইয়ের প্রতি ভালবাসা
গ. মেয়ে জামাইয়ের প্রতি ঘৃণা ঘ. নাত জামাইয়ের প্রতি ভালবাসা

নিচের উদ্দীপকটি পড়–ন এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দিন 
বন্যা পরবর্তী সময়ে গ্রামটিতে আকাল পড়েছে। লতিফা তার দুধের সন্তানকে বলতে গেলে একরকম অনাহারেই রেখেছে। খাদ্য যোগাড় করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

৩. উদ্দীপকের লতিফার সঙ্গে ‘মাসিপিসি’ গল্পে কোন চরিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে?
ক. মসি-পিসি খ. আহ্লাদি
গ. কৈলাশ ঘ. জগু

৪. এরূপ সাদৃশ্যের কারণ-
i. জীবনসংগ্রাম
ii. অস্তিত্ব-সংকট
iii. বন্যা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i     খ. ii
গ. iii   ঘ. i, ii ও iii

৫. আহ্লাদিকে পাওয়ার জন্য মাসিপিসিকে কে পাগল করে তুলেছে?
ক. কানাই      খ. গোকুল
গ. কৈলেশ     ঘ. দারোগা বাবু 

৬. ‘বাজারের তোলা’ বলতে বোঝায়-
ক. বিক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করা কর খ. ক্রেতাদের দেয়া ক্ষতিপূরণ
গ. বিক্রেতাদের লাভের অংশ ঘ. ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগকৃত অর্থ

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ৭ ও ৮ নং প্রশ্নের উত্তর দাও:
আহারে। এরে মাইয়াডারে মাইরা ফালাইস না। ওরে ও পাষাইণ্যা, দরজা খোল, মারিস না, আর মারিস না, জাহান্নামে যাইবি, মারিস না। বাইরে থেকে দু’হাতে ঝাঁপিটাকে ঠেলছে ফকিরের মা। আবুল একবার তাকাল সেদিকে, কিন্তু ঝাঁপি খুলল না।

৭. উদ্দীপকের সঙ্গে ‘মাসিপিসি’ গল্পে কোন চরিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে?
ক. কৈলেশ খ. জগু
গ. কানাই ঘ. গোকুল

৮. এরূপ সাদৃশ্যপূর্ণ দিকটি হল-
i. নারী নির্যাতনে
ii. সমাজে পুরুষতন্ত্রে
iii. নারীর অসহায়তায়
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i   খ. ii    গ. iii   ঘ.i, ii, iii

৯. ‘সোমত্ত’ শব্দের অর্থ কী?
ক. ষন্ডা খ. যৌবনপ্রাপ্ত
গ. সোমবার ঘ. শাস্তি

১০. মাসিপিসির সমস্ত মন জুড়ে কোন ভাবনা কাজ করে?
ক. নতুন সংসার রচনা খ. পালিয়ে যাবার চিন্তা
গ. আহ্লাদিকে রক্ষা করা ঘ. ব্যবসায়ে উন্নতি

নিচের উদ্দীপকটি পড়–ন এবং ১১ ও ১২ নং প্রশ্নের উত্তর দিন:
পৃথিবীতে সাহসীরাই টিকে থাকে। কেননা সাহস মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ভীরু কাপুরুষেরাই কেবল মরে। বার বার মরে।

১১. উদ্দীপকের মূলভাব প্রকাশ পেয়েছে যে চরিত্রে-
ক. পিসি-আহ্লাদি খ. মাসিপিসি
গ. জগু-কৈলাশ ঘ. কানাই-দারোগা বাবু

১২. উদ্দীপক ও ‘মাসিপিসি’ গল্পে ফুটে উঠেছে-
i. সাহসের বিকল্প নেই
ii. ভয় বিপদ বাড়ায়
iii . ভয় পুরুষতন্ত্রের সহায়ক
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i      খ. ii
গ. iii    ঘ. ii ও  iii

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর


১. ক     ২. খ     ৩. ক     ৪. খ    ৫. খ     ৬. ক    ৭. খ     ৮. ঘ     ৯. খ     ১০. গ      ১১. খ   ১২. ঘ





এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনেট আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url